অ্যাসিড দগ্ধ হওয়ার ৩৬ ঘণ্টা পেরিয়েছে। শরীরের যন্ত্রণা কি এত দ্রুত কমে! এরই মধ্যে গর্ভের সন্তান নিয়ে উদ্বেগে ছটফট করছিলেন আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা মিলি আক্তার (২০)।
তিনি এখন শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন।
অ্যাসিড দগ্ধ হওয়ার যন্ত্রণা আর গর্ভের সন্তান
প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়ে গ্রামের এক ব্যক্তির ছোড়া অ্যাসিডে মিলি আক্তার দগ্ধ হন। গত রোববার রাত সাড়ে ১০টায় চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার সুজাতপুর গ্রামে এ ঘটনা ঘটে।
গত ২৪ বছরে অ্যাসিডদগ্ধ ব্যক্তিদের ৬০ শতাংশ নারী। বর্তমানে প্রায় ৬০০ মামলা অ্যাসিড অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন। মৃত্যুদণ্ডের রায় হয়েছে ১৪ জনের। তবে এখনো কারও ফাঁসি কার্যকর হয়নি।
আজ মঙ্গলবার সকাল সোয়া ১০টায় এ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ৩ নম্বর শয্যায় গিয়ে দেখা যায়, মিলির পাশে উৎকণ্ঠিত স্বজনেরা। মিলি চোখ বন্ধ করে আছেন। মুখে অক্সিজেন মাস্ক।
পুরো মুখ পুড়ে কালো বর্ণ ধারণ করেছে। শরীর ব্যান্ডেজে মোড়া থাকায় দগ্ধ হওয়ার পরিমাণ বোঝা যায় না। জরুরি বিভাগ থেকে তাঁকে হাই ডিপেনডেন্সি ইউনিটে (এইচডিইউ) স্থানান্তর করার প্রক্রিয়া চলছে।
মিলির চাচাতো ভাই শাকিল হোসেন এ প্রতিবেদককে জানান, মিলি চোখ খুলতে পারছেন না। তবে কথা বলছেন। গর্ভের সন্তানের কোনো ক্ষতি হয় কি না, তা নিয়ে খুব দুশ্চিন্তা করছেন।
এ প্রতিবেদকের প্রশ্নের জবাবে মিলি পেটে হাত দিয়ে জানালেন, গর্ভের সন্তানের নড়াচড়া টের পাচ্ছেন তিনি।১০ মাস আগে সৌদিপ্রবাসী মো. সায়েমের সঙ্গে বিয়ে হয় মিলির (২০)। তিনি এখন আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা।
১০ দিন আগে শ্বশুরবাড়ি থেকে বাবার বাড়ি বেড়াতে আসেন।
শ্বশুরবাড়ি ফিরে যাওয়ার আগের রাতে তিনি অ্যাসিডে দগ্ধ হন। পুলিশ জানিয়েছে, এ ঘটনায় শফিকুল ইসলাম ওরফে মানিক (২৫) নামের এক তরুণকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
গতকাল সোমবার বিকেলে মিলির বাবা মো.আইয়ুব আলী শফিকুলকে প্রধান আসামি ও বাদল নামের সৌদিপ্রবাসী এক ব্যক্তিকে ইন্ধনদাতা হিসেবে আসামি করে মতলব উত্তর থানায় মামলা করেছেন।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুসারে, অ্যাসিড অপরাধ দমন আইন ২০০২–এর অধীন ২০১৭ থেকে ২০২৩ সালের জুলাই পর্যন্ত দেশে ২৩৮টি মামলা হয়েছে।
বেসরকারি সংস্থা অ্যাসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশনের (এএসএফ) তথ্য অনুসারে, ১৯৯৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ২৩ বছরে দেশে ৩ হাজার ৮৭০ জন অ্যাসিডে দগ্ধ হয়েছেন।
২০২৩ সালে আট নারী, তিন পুরুষ ও দুই শিশু দগ্ধ হয়। চলতি বছরের জানুয়ারিতে ছয় নারী, এক পুরুষ ও এক শিশু দগ্ধ হয়েছে। গত ২৪ বছরে অ্যাসিডদগ্ধ ব্যক্তিদের ৬০ শতাংশ নারী।
এ ছাড়া বর্তমানে প্রায় ৬০০ মামলা অ্যাসিড অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন। মৃত্যুদণ্ডের রায় হয়েছে ১৪ জনের। তবে এখনো কারও ফাঁসি কার্যকর হয়নি।
অ্যাসিডের ক্ষত অনেক গভীরে যায়। সে ক্ষেত্রে গর্ভের সন্তান ঝুঁকিতে পড়তে পারে, না-ও পারে। গাইনি চিকিৎসক দেখেছেন। এখন পর্যন্ত (মিলির) গর্ভের সন্তান ভালো আছে।
“মো. তরিকুল ইসলাম, শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের জরুরি বিভাগের আবাসিক সার্জন”
শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের জরুরি বিভাগের আবাসিক সার্জন মো. তরিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, মিলির শরীরের ৯ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে।
তাঁর অবস্থা আশঙ্কাজনক না হলেও মুখমণ্ডল অনেকটা পুড়েছে। গলা ও ডান হাতের কিছু অংশ পুড়েছে।
মিলির গর্ভের সন্তানের কোনো ঝুঁকি আছে কি না জানতে চাইলে তরিকুল ইসলাম বলেন, ‘অ্যাসিডের ক্ষত অনেক গভীরে যায়।
সে ক্ষেত্রে গর্ভের সন্তান ঝুঁকিতে পড়তে পারে, না–ও পারে। গাইনি চিকিৎসক দেখেছেন। এখন পর্যন্ত গর্ভের সন্তান ভালো আছে।’
বিবাহিত হয়েও উত্ত্যক্ত করতেন শফিকুল
মিলির চাচাতো ভাই শাকিল হোসেন বলেন, মিলি ও সায়েম একে অপরকে পছন্দ করতেন। পারিবারিকভাবে তাঁদের বিয়ে হয়।
অ্যাসিড হামলার রাতে ঘরে নামাজ আদায় করছিলেন মিলি ও তাঁর মা রাশেদা বেগম (৫৫)। এ সময় দরজায় টোকা দিয়ে ‘কাকি কাকি’ বলে কেউ একজন ডাকছেন বলে শোনেন তাঁরা।
এক ফাঁকে মিলি উঠে গিয়ে দরজা খোলামাত্র তাঁর মুখে–গায়ে অ্যাসিড ছুড়ে মারা হয়। এতে তাঁর পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা মায়ের পা সামান্য দগ্ধ হয়।
প্রথমে মা–মেয়েকে মতলব উত্তর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও পরে রাত দেড়টার দিকে ঢাকার শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে আনা হয়।
আসামি একই গ্রামের শফিকুল বিবাহিত ও এক সন্তানের জনক। তিনি একজন দোকানি। বিবাহিত হলেও কলেজে আসা–যাওয়ার পথে মিলিকে উত্ত্যক্ত করতেন।
বলতেন, ‘অ্যাসিড দিয়ে মুখ ঝলসে দেব’। এমনকি মিলি অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার খবর পেয়েও শফিকুল ভিন্ন নম্বর থেকে অশ্লীল খুদে বার্তা পাঠিয়ে বলতেন, ‘তুই মা হলেও পিছু ছাড়ব না।’
আর বাদল দেশে থাকতে উত্ত্যক্ত করতেন মিলিকে। মিলির বিয়ে ঠিক হলে তাঁর স্বামীকে বিদেশ থেকে ফোন করে হুমকি দিয়েছিলেন বাদল।
শাকিল হোসেন বলেন, আসামিদের যেন শাস্তি নিশ্চিত হয় সেই দাবি তাঁদের।
মেয়ের শ্বশুর মালয়েশিয়াপ্রবাসী। বাড়িতে শাশুড়ি, মিলি ও এক দেবর থাকেন। দিন ১০ আগে মিলি বাবার বাড়ি বেড়াতে আসেন। গতকাল শ্বশুরবাড়ির লোকজনের তাঁকে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল।
মামলার বিষয়ে মতলব উত্তর থানার ওসি মো. শহীদ হোসেন আজ প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল দুজনকে আসামি করে অ্যাসিড অপরাধ দমন আইন, ২০০২–এর ৫/৬/৭ ধারা এবং দণ্ডবিধির ১১৪/৩৪১/৫০৬(২) ধারায় মামলা করা হয়েছে।
শফিকুলকে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য আদালতে আবেদন করা হয়েছে।
জানা গেছে, ফরেনসিক পরীক্ষার পর নিশ্চিত হওয়া যাবে, মিলিকে যা ছোড়া হয়েছে তা অ্যাসিড নাকি অন্য কোনো দাহ্য পদার্থ।
আইনে যা আছে
অ্যাসিড অপরাধ দমন আইন, ২০০২–এর ৫ ধারার দুটি উপধারায় অ্যাসিডে ক্ষতির পরিমাণ অনুপাতে অপরাধীর শাস্তি নির্ধারণ করা আছে।
এতে সর্বনিম্ন ৭ বছর ও সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড বা মৃত্যুদণ্ডের বিধান আছে। ৬ ধারা অনুসারে, অ্যাসিড নিক্ষেপ বা নিক্ষেপের চেষ্টা করলে সর্বনিম্ন দুই বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও সর্বোচ্চ ৭ বছরের কারাদণ্ড হবে।
আর ৭ ধারা অনুসারে, কোনো ব্যক্তি অপরাধ সংঘটনে সহায়তা করলে তিনি নির্ধারিত দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
দণ্ডবিধি ১৮৬০–এর ১১৪ ধারা অনুসারে অপরাধ সংঘটনকালে সহায়তাকারী উপস্থিত থাকলে অপরাধ করেছে বলে গণ্য হবে।
৩৪১ ধারা অনুসারে কাউকে অবৈধ বাধাদানের শাস্তি হিসেবে এক মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং ৫০৬ (২) ধারা অনুসারে, অপরাধমূলক ভীতি প্রদর্শনের শাস্তির বিষয়ে অপরাধের ধরন অনুসারে ৭ বছরের কারাদণ্ড থেকে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে।
আর ফরেনসিক পরীক্ষায় যদি নিক্ষেপ করা পদার্থ অ্যাসিড নয় বলে জানা যায়, তাহলে তা দাহ্য পদার্থ হিসেবে মামলা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০–এর ৪ ধারায় রূপান্তরিত হতে পারে।
এই ধারা অনুসারে দহনকারী পদার্থে সংঘটিত অপরাধের শাস্তি অ্যাসিড নিক্ষেপের মতোই।
এ ছাড়া যদি কোনো ব্যক্তি দহনকারী, ক্ষয়কারী অথবা বিষাক্ত পদার্থ কোনো শিশু বা নারীর ওপর নিক্ষেপ করেন বা করার চেষ্টা করেন এবং এতে কোনো ক্ষতি না হলেও নিক্ষেপকারী সর্বোচ্চ ৭ বছর ও সর্বনিম্ন ৩ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
উৎসঃ প্রথম আলো