বাংলাদেশে অফশোর ব্যাংকিং ব্যবস্থা নিয়ে নতুন যে আইনটি চূড়ান্ত করা হয়েছে তাতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বৃদ্ধি, রিজার্ভ সংকট ও এলসি খোলার সংকট সমাধান-সহ বিদেশি বিনিয়োগ আরও উৎসাহিত হবে বলে মনে করছেন ব্যাংক খাত সংশ্লিষ্টরা।
তারা বলছেন, কোনও ব্যক্তি নয় বরং আন্তর্জাতিক অর্থ ব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে অফশোর ব্যাংকিং ব্যবস্থা ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলেই এই আইন জরুরি ছিলো।
কিন্তু গণমাধ্যমে আলোচনায় আসা এই অফশোর ব্যাংকিং আসলে কী?
সাধারণ ব্যাংকিং-এর সাথে এর পার্থক্যই বা কী? কারা এর গ্রাহক? এই ব্যাংকিং ব্যবস্থায় সরকারের উপরই বা কী প্রভাব পড়বে? মঙ্গলবার মন্ত্রিপরিষদ অফশোর ব্যাংকিং আইন ২০২৪-এর চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে।
অফশোর ব্যাংকিং কি?
অফশোর ব্যাংকিং হলো ব্যাংকের ভেতরে পৃথক ব্যাংকিং সেবা। প্রচলিত ব্যাংকিং বা শাখার কার্যক্রমের চেয়ে ভিন্ন অফশোর ব্যাংকিং।
কারণ এ জাতীয় কার্যক্রমে আমানত গ্রহণ ও ঋণ দেওয়ার দুই কার্যক্রমই বৈদেশিক উৎস থেকে আসে ও বিদেশি গ্রাহকদের দেওয়া হয়।
এই ব্যাংকিং কার্যক্রম শুধু অনিবাসীদের মধ্যেই সীমিত থাকে। বিদেশি কোম্পানিকে ঋণ দেয়া ও বিদেশি উৎস থেকে আমানত সংগ্রহের সুযোগ রয়েছে অফশোর ব্যাংকিংয়ে।
স্থানীয় মুদ্রার পরিবর্তে বৈদেশিক মুদ্রায় হিসাব হয় অফশোর ব্যাংকিংয়ে। অফশোর ব্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে প্রচলিত ব্যাংকের কোনো নিয়ম – নীতিমালা প্রয়োগ করা হয় না।
আলাদা আইনকানুনের মাধ্যমে এ তহবিল পরিচালিত হয় ও হিসাব সংরক্ষণ করা হয়। কেবল মুনাফা ও লোকসানের হিসাব যোগ হয় ব্যাংকের মূল মুনাফায়। অফশোর ইউনিট থেকে ব্যাংকগুলো বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ দিয়ে থাকে।
এটি এমন ব্যাংকিং কার্যক্রমকে নির্দেশ করে যা শুধুমাত্র অনিবাসীদের যেমন: মাল্টিন্যাশনাল পণ্য, সেবা এবং ফাইন্যান্সারদের সম্পৃক্ত করে। এটি দেশীয় ব্যাংকিংয়ের সাথে যুক্ত হয় না।
নতুন আইনে যা বলা হয়েছে
বাংলাদেশে ১৯৮৫ সালে অফশোর ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনের ভিত্তিতে সে সময় কাজ শুরু হয়েছিলো।
পরে ২০১৯ সালে অফশোর ব্যাংকিং নীতিমালা জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। বুধবার অফশোর ব্যাংকিং আইন ২০২৪-এর খসড়ার নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশের মন্ত্রিপরিষদ।
এর ফলে বাংলাদেশে বিনিয়োগকারী অনিবাসী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানগুলো অফশোর অ্যাকাউন্ট খুলতে পারবে। এই খসড়ায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তফসিলি ব্যাংকগুলোকে লাইসেন্স নিতে হবে।
শুধুমাত্র লাইসেন্সধারী ব্যাংকগুলোতে অফশোর অ্যাকাউন্ট খোলা যাবে। যাদের লাইসেন্স আছে তাদের নতুন করে নিতে হবে না।
বাংলাদেশে বর্তমানে ৩৯ টি ব্যাংক অফশোর ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এ ধরনের ব্যাংকিং কার্যক্রমে যারা বিনিয়োগ করবে তারা বিদেশি বা অনিবাসী কোনও ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান হতে হবে।
অনুমোদিত এই আইনের অধীনে ব্যাংকগুলো বিদেশি বা অনিবাসী কোনও ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বৈদেশিক মুদ্রায় যে আমানত গ্রহণ করবে তা স্বাভাবিক ব্যাংকিং পদ্ধতিতে ব্যবহার করতে পারবে।
বিদেশে যে বাংলাদেশি বসবাস করছেন তার পক্ষে দেশে অবস্থানরত কোনও বাংলাদেশি নাগরিক অ্যাকাউন্ট খুলতে পারবেন। সহায়তাকারী হিসেবে তারা অ্যাকাউন্ট পরিচালনা করতে পারবেন।
পাঁচ ধরণের বৈদেশিক মুদ্রা – ডলার, পাউন্ড, ইউরো, জাপানি ইয়েন ও চীনা ইউয়ানে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করা যাবে।
বর্তমানে যে অফশোর ব্যাংকিং ব্যবস্থা রয়েছে তাতে ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বর (টিআইএন) না থাকলে আমানতের আয়ের উপর ১৫ শতাংশ কর দিতে হয়। আর টিআইএন থাকলে ১০ শতাংশ কর দিতে হয়। নতুন আইনে কোনও কর দিতে হবে না।
একই সাথে অফশোর ব্যাংকিং লেনদেনে যে সুদ আসবে তার উপর কোনও কর আরোপ করা হবে না। অ্যাকাউন্ট পরিচালনার জন্য কোনও সুদ বা চার্জ দিতে হবে না।
বর্তমানে অনাবাসী বাংলাদেশি নাগরিকদের কাছ থেকে আমানত নেওয়ার কোনও নিয়ম নেই।
এ আইনটি পাস হলে তফসিলি ব্যাংকের অফশোর ইউনিটগুলো বিদেশিদের পাশাপাশি অনাবাসী বাংলাদেশি নাগরিকদের কাছ থেকেও আমানত নিতে পারবে।
অনুমোদিত নতুন আইনে কোন ঋণসীমা রাখা হয় নি, এতে যে কোনও পরিমাণ লেনদেন করা যাবে।
বর্তমানে বাংলাদেশে ইপিজেডে যে অফশোর অ্যাকাউন্ট রয়েছে তা কারেন্ট অ্যাকাউন্ট। এসব অ্যাকাউন্টে কোন লাভ দেওয়া হয় না।
তবে, নতুন আইনে অফশোর ব্যাংকিং কার্যক্রমে লাভ দেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে।
অফশোর ব্যাংকিং-এর সুবিধা ও অসুবিধা
ব্যাংকাররা বলছেন, এই ব্যাংকিং পদ্ধতিতে অসুবিধার চাইতে সুবিধাই বেশি। এই ব্যাংকিংয়ে যে কোনও কোম্পানি বা ব্যক্তি দেশ বিদেশে সহজ শর্তে ব্যবসা করতে পারবে।
অনুমোদিত নতুন আইনের আওতায় সরকার এই ব্যাংকিং কার্যক্রমে আকর্ষণীয় সুযোগ সুবিধা দিয়ে থাকে। প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থার সাথে এর পার্থক্য হলো এতে বিধিনিষেধ একেবারেই কম।
গ্রাহকের তথ্য সংক্রান্ত চূড়ান্ত গোপনীয়তা বজায় রাখা হয়। তবে অসুবিধাও রয়েছে বলে মনে করছেন ব্যাংকাররা।
মেঘনা ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুরুল আমিন বিবিসি বাংলাকে বলেন, “ অতীতে এমন উদাহরণও রয়েছে, অফশোরের মাধ্যমে বিদেশ থেকে লোন নিয়ে দেশে ব্যবসা করছে , দেশে লোন শোধ করছে। এক্ষেত্রে তার এক্সপোর্ট সেভাবে না থাকলে ওই লোন শোধ হওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে।”
“তার মানে তাকে উল্টা করে লোকাল টাকা দিয়ে লোন শোধ করার সুযোগ নেই। পর্যাপ্ত এক্সপোর্টের মাধ্যমে কাভার না করলে ওই লোন পরিশোধ কঠিন হয়ে পড়ে” বলেন মি. আমিন।
এ সমস্যা রোধে তদারকি করা প্রয়োজন বলে মনে করছেন সাবেক এই ব্যাংকার। তিনি বলেন, “ যে কারণে লোন দেয়া হচ্ছে সেটা পালন হচ্ছে কিনা সেটা মনিটরিং জরুরি।”
তিনি আরও বলেন, “এই কার্যক্রমের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো দেশে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বাড়বে। কারণ যারা এতে অংশ নেবে তাদের সর্বোচ্চ সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয়। অনেক ক্ষেত্রেই তাদের রেস্ট্রিকশন কম থাকবে। কারণ ফরেন কারেন্সির ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ অনেক উদার করা হয়েছে।”
বুধবার বাংলাদেশের মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মাহবুব হোসেন সচিবালয়ে এই আইনের খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন। গণমাধ্যমে তিনি বলেন, “এটা এখন সর্বাধুনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থা।
পৃথিবীর বহু দেশ এ পদ্ধতি অনুসরণ করে তাদের বৈদেশিক রিজার্ভ ও আর্থিক কাঠামোকে সমৃদ্ধ করেছে। এতে করে তারা শত শত কোটি ডলার বিনিয়োগ পেয়েছে।”
“এছাড়া আমরা এটিকে একটি অপশন হিসেবে ব্যবহার করছি, যাতে বিদেশিরা এসে টাকা রাখতে পারে। তবে বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে টাকা নিয়ে যাওয়া যায় না।
এক্ষেত্রে অনুমতি নিতে হয়। অফশোর এই আইনে স্বাধীনভাবে অপারেট করা যাবে”, জানান মি হোসেন।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব আরো জানান, “বাংলাদেশে যেসব বিদেশি বিনিয়োগ করে লভ্যাংশ নিয়ে যান, তখন তারা বাইরের অফশোর কোনও ব্যাংকিং ব্যবস্থায় টাকা রাখেন। আবার আমাদের এখানে যখন আনেন, তখন তারা আমাদের কোনো অভ্যন্তরীণ ব্যাংকে ঢোকান না।”
” কারণ যখন তারা নিয়ে যাবেন তখন নানান বাধার সম্মুখীন হতে হয়। এখানে একটা সুবিধা হবে বিদেশিরা ব্যবসা করে যে লভ্যাংশ পাবেন, সেটা এখন ব্যাংকে রাখবেন।”
“কারণ এখন ব্যাংকে টাকা রাখলেই লাভ দেয়া হচ্ছে। যেটা আন্তর্জাতিক মানের। সুতরাং এখানে বিদেশিরা বিনিয়োগে আগ্রহী হবেন”, এই আশা প্রকাশ করেছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্যই এটি করা হচ্ছে বলে জানান মি. হোসেন। বিভিন্ন ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানান, অফশোর ব্যাংকিং-এর আওতায় ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস অ্যাকাউন্ট খুলতে হয়।
অনাবাসী বাংলাদেশিরা বিদেশ থেকে যখন দেশে থাকা অফশোর ব্যাংকিং-এর অ্যাকাউন্টে বৈদেশিক মুদ্রা পাঠাবে, তখন সেই মুদ্রাতেই লেনদেন করবে। এছাড়া এ ধরনের অ্যাকাউন্টধারীদের সরকার প্রচুর ট্যাক্স বেনিফিট দিয়ে থাকে।
ঊর্ধ্বতন ব্যাংক কর্মকর্তারা জানান, কোনও অনাবাসী ব্যক্তি বা কোম্পানি যখন বাংলাদেশের অফশোর অ্যাকাউন্টে বিদেশি মুদ্রা পাঠাবে তখন সে নিজের প্রয়োজনে এই অর্থ নিতে পারবে।
পরিবারের প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারবে। আবার টাকায় এনক্যাশ করে শেয়ার বা বন্ড কিনতে পারবে।
মূলত বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বাড়ানো, রিজার্ভ সংকট, এলসি খোলার সংকট সমাধানে এই অফশোর ব্যাংকিং এর নতুন আইন কাজ করবে বলে মনে করছেন ঊর্ধ্বতন ব্যাংক কর্মকর্তারা।
উৎসঃ বিবিসি