কুয়ালালামপুর থেকে চীনের বেইজিং যাওয়ার পথে মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্স-এর ফ্লাইট এমএইচ ৩৭০ নিখোঁজ হওয়ার প্রায় এক দশক হয়ে গেছে।
২০১৪ সালের ৮ মার্চ রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হওয়া এই বিমানটিতে ২৩৯ জন আরোহী ছিলেন। তাদের মাঝে মাত্র ১২ জন ছিলেন ক্রু। বাকিরা সবাই যাত্রী এবং এই যাত্রীদের বেশিরভাগই ছিলেন চীনের।
হারিয়ে যাওয়ার পর বিমানটিকে খুঁজে পাওয়ার জন্য টানা কয়েক বছর নানা উদ্ধার অভিযান চালানো সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত বিমানটির ন্যূনতম হদিস পাওয়া যায়নি।
এই যুগে একটি আস্ত বিমান হারিয়ে যেতে পারে কি না
ভারত মহাসাগরের এক লাখ বিশ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে তল্লাশি চালিয়েও নিখোঁজ বিমানের কোনও ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়নি বলে ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে এটিকে খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা ছেড়ে দিয়ে তল্লাশি বন্ধ করে দিয়েছিলো তদন্তকারীরা।
যদিও ২০১৫ সালের পাঁচই আগস্ট মালয়েশিয়ার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক একবার বলেছিলেন যে দক্ষিণ ভারত মহাসাগরে অবস্থিত রিইউনিয়ন দ্বীপে নিখোঁজ বিমানের ধ্বংসাবশেষের একটি অংশ পাওয়া গেছে এবং সেটি হলো ফ্ল্যাপেরন, অর্থাৎ বিমানটির ডানার একটি টুকরো।
এছাড়া, অভিযানের ঐ সময়ে মোট ২০টি টুকরো বিভিন্ন জায়গা থেকে উদ্ধার করা হয়েছিলো। যার মধ্যে সাতটি টুকরোকে নিখোঁজ এমএইচ ৩৭০ বিমানের বলে উল্লেখ করা হয়েছিলো।
তবে বিমানটিতে যেসব আরোহীরা ছিলেন, তাদের আত্মীয়েরা এখনও বিমানটিকে নিশ্চিতভাবে খুঁজে পাওয়ার আশা ছাড়েননি। তারা নতুন করে অনুসন্ধানের দাবি করেছেন।
বিমানটি হারিয়ে যাওয়ার দশ বছর পূর্তিতে গতকাল ঐ বিমানে থাকা আরোহীদের স্বজনরা এই দাবিতে কুয়ালালামপুরের একটি বিপণনকেন্দ্রে নিয়ে জড়ো হন।
তবে এবছরের মতো প্রতিবছরই এই বিমানটি নিয়ে পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি হয়। কারণ বিমান চলাচলের ইতিহাসে এতটা রহস্যজনকভাবে এ পর্যন্ত কোনও যাত্রীবাহী বিমান এভাবে হারিয়ে যায়নি।
আজ থেকে দশ বছর আগে যখন বিমানটি হারিয়ে যায়, সেই সময়কার প্রযুক্তি এখনকার চেয়ে খুব একটা পুরনো ছিল না। তাই, এই যুগে একটা বিমানের এভাবে উধাও হয়ে যাওয়াটা বিশ্ববাসীর কাছে বিস্ময়কর।
বেসরকারি বিমান সংস্থা ফ্লাই ঢাকা এয়ারলাইন্সে কর্মরত ফ্লাইট ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ আল ফারুক বিবিসি বাংলাকে বলেন, “একটি বিমান রাডার থেকে চলে গিয়ে সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে যাবে, এটি এই যুগে একটি রহস্যজনক ঘটনা। পশ্চিমাদেরও এই বিষয়ে আগ্রহ খুবই কম।”
“তারা অনেক বছর অনেক খোঁজাখুঁজি করার পর টাইটানিক খুঁজে বের করেছিলো। এ বেলায়ও অনেক খোঁজ করা হয়েছে। কিন্তু তারপরও বিমানের খোঁজাটা কেমন যেন এক পর্যায়ে থেমে গেছে।”
একটি বিমান কখন খুঁজে পাওয়া সম্ভব?
ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ জানান, পাঁচটি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে একটি বিমানকে খুঁজে বের করা সম্ভব।
১) ট্রান্সপন্ডার
স্যাটেলাইটের মাধ্যমে রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি বা ডেটা বিনিময় করার জন্য যে ডিভাইস ব্যবহার করা হয়, সেটিকে ট্রান্সপন্ডার বলে। বিমান চলাচলের জন্য ট্রান্সপন্ডার খুব গুরুত্বপূর্ণ।
সব বিমানেই থাকে ট্রান্সপন্ডার। এটির মাধ্যমেই এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলারের (এটিসি) সাথে যোগাযোগ করা হয় এবং বিমানের অবস্থান শনাক্ত করা হয়।
২) এডিএস-বি
এডিএসডি-বি, এর পূর্ণ রূপ হলো এডোমেটিক ডিপেন্ডেন্ট সার্ভেইল্যান্স–ব্রডকাস্ট। এটিও এমন প্রযুক্তি, যা দিয়ে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে বিমানের অবস্থান শনাক্ত করা হয়।
ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ বলেন, “বিমানে যদি এটি ইনস্টল করা থাকে এবং এডিএস-বি যদি অপারেটিভ থাকে, তাহলে বিমানটি কোথায় আছে, সেই তথ্য পাওয়া যাবে।”
৩) এসিএআরএস
এয়ারক্রাফ্ট কমিউনিকেশন, অ্যাড্রেসিং অ্যান্ড রিপোর্টিং সিস্টেম (এসিএআরএস)। এটি এয়ারলাইন্স কোম্পানি, প্রস্তুতকারক এবং অন্যান্য সংস্থার মধ্যে স্বয়ংক্রিয় বার্তা পাঠাতে পারে।
৪) ব্ল্যাক বক্স
ফ্লাইট রেকর্ডার, যা সাধারণত ব্ল্যাক বক্স নামে পরিচিত। এটি মূলত একটি ইলেকট্রনিক রেকর্ডিং ডিভাইস, যেখানে বিমানের সমস্ত তথ্য সংরক্ষিত থাকে।
তবে এটিকে ব্ল্যাক বক্স ডাকা হলেও এটি দেখতে কালো নয়। বরং, কমলা রঙের। অত্যন্ত শক্ত ধাতব পদার্থ দিয়ে তৈরি এই ফ্লাইট রেকর্ডারকে এমনভাবে তৈরি করা হয়, যাতে এটি প্রচণ্ড উত্তাপ, ভাঙচুর, পানি বা প্রচণ্ড চাপের মধ্যেও টিকে থাকতে পারে।
কোনও বিমান দুর্ঘটনার পর তদন্তের কাজে এই ব্ল্যাক বক্স মুখ্য ভূমিকা রাখে।
৫) মে-ডে কল
‘মে-ডে কল’, সহজ ভাষায় কথাটির অর্থ হতে পারে ‘সাহায্যের প্রয়োজনে ডাক’।
একটি বিমান যখন বিপদের সম্মুখীন হয় এবং অবিলম্বে সহায়তার প্রয়োজন হয়, তখন বিমানের পাইলট উচ্চ স্বরে একসাথে তিনবার ‘মে-ডে, মে-ডে, মে-ডে’ বলেন।
সাধারণত যখন জীবনের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ে, কেবল তখনই পাইলট এটি উচ্চারণ করেন। এটি বলা হলে এটিসি এবং আশেপাশের বিমানগুলোর কাছে খবর চলে যায় যে একটি বিমান ঝুঁকিতে আছে।
এমএইচ ৩৭০ বিমানে কী এই বিষয়গুলো ছিল না?
ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ বলেন যে এমএইচ ৩৭০ বিমানে এই পাঁচটি বিষয়ের কোনোটাই কার্যকরি ছিল না।
“সেক্ষেত্রে এটা স্যাবোটাজ হতে পারে বা প্রযুক্তিগত ভুল হতে পারে। কিন্তু এখানে যে পাঁচটি বিষয়, তার একটা কেবল মৌখিক, চারটা ইন-বিল্ট। তো, চারটাই একসাথে ম্যালফাংশন (অকেজো) হয়ে যাবে?”
“আমার মতে, এখানে দুইটা জিনিস হতে পারে। টেকনিক্যাল ফল্ট, বা স্যাবোটাজ বাই দ্য হেল্প অব আদারস…। মে ডে বাদ দিলাম, বাকি চারটা একসাথে অকেজো হওয়া ইম্পসিবল।”
উল্লেখ্য, স্যাবোটাজ মানে হলো ইচ্ছাকৃতভাবে বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে যে নাশকতা করা হয়।
সব প্রযুক্তি এভাবে অকেজো হওয়ার ঘটনা এভিয়েশন জগতে কখনও ঘটেনি উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এই চারটির মাঝে এডিএস-বি পাইলট অফ করতে পারে না। বাকিগুলো পাইলট অফ করতে পারে।”
“আমার ফ্লাইং ইতিহাসে আমি কখনও ট্রান্সপন্ডার নষ্ট পাই নাই। আর, ট্রান্সপন্ডার নষ্ট হলে টাওয়ার (এটিসি) থেকে বলে যে উই লস্ট ইওর ট্রান্সপন্ডার। সেক্ষেত্রে তারা ফ্লাই করার জন্য অ্যালাউ করতে পারে, আবার ফিরে যেতেও বলতে পারে। কারণ তারা আমাকে (বিমানকে) দেখতে পারছে না।”
“আর ট্রান্সপনডার নষ্ট হলে এডিএস-বি আছে। এটা দিয়ে টাওয়ার তো আমার অবস্থান দেখতে পারে। কিন্তু রহস্যজনকভাবে উড্ডয়নের এক ঘণ্টা ২১ মিনিট পর বিমানের এডিএস-বি বন্ধ হয়ে গেছিলো।”
তিনি জানান, এডিএস-বি বন্ধ হওয়ার আগে বিমানের ট্রান্সপন্ডারও বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু এটিকে বন্ধ করতে হলে সেটা বিমানেরই কাউকে করতে হবে।
“এডিএস-বি অফ হলো। তার আগে বিমান ওড়ার কয়েক মিনিট পরই ট্রান্সপন্ডার বন্ধ হয়ে গেছিলো। এই বিমানের ব্ল্যাক বক্সটা পাওয়া গেলে বোঝা যেত যে পাইলট ইচ্ছে করে সুইচ অফ করেছে, না কি অটোমেটিক্যালি সুইচ অফ হয়ে গেছে,” যোগ করেন তিনি।
প্রতিবেদনে আগেই বলা হয়েছে যে অনেক খোঁজাখুঁজির পরও এই বিমানের কোনও নিশ্চিত চিহ্ন পাওয়া যায়নি। সেখানে, বিমানের ব্ল্যাক বক্স খুঁজে না পাওয়াটা বিস্ময়কর কিছু না।
তিনি বলেন, ব্ল্যাক বক্স পানির ২০ হাজার ফিট নিচে থাকলেও সে তার অবস্থান জানান দিতে পারে।
এই বিমানের ব্ল্যাক বক্সের সন্ধান না পাওয়া সম্বন্ধে তিনি বলেন, “যদি এটি (বিমান) এমন এক অ্যাঙ্গেলে, অর্থাৎ ৪৫ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে সমুদ্রের মাঝে ডাইভ দিয়ে থাকে, আর তার ডেপথ ২০ হাজার ফিটের বেশি হয়ে থাকে, তাহলে বিমানটি একই অবস্থায় ওখানেই বসে আছে।”
“ঐ পজিশনে সে আছে, কিন্তু ব্ল্যাক বক্সটা কোনও ট্রান্সমিট করতে পারছে না। পারলেও আমরা সেটার রেঞ্জের বাইরে, তাই কিছু ডিটেক্ট করতে পারছি না,” যোগ করেন মি. আব্দুল্লাহ।
এ তো গেল প্রযুক্তির কথা। কিন্তু মালয়েশিয়ার হারিয়ে যাওয়া বিমানের পাইলট মে-ডে কলও করেননি।
“উনি (পাইলট) ট্রান্সপন্ডার কেন বন্ধ করে দিলো, এডিএস-বি কেন বন্ধ হয়ে যাবে, ব্ল্যাক বক্স না হয় ২০ হাজার ফিটের নিচে আছে। তাহলে কি গ্রাউন্ড থেকে পরিকল্পিত ছিল যে তোমার ব্ল্যাকবক্স থাকবে না, ট্রান্সপন্ডার থাকবে না, এডিএস-বি থাকবে না, এমনকি লাস্ট মিনিটে কলও দিবা না…?”
এই ক্যাপ্টেন আরও বলেন, “আমার ইমার্জেন্সি হলে আমি কল দিবো যে ইমারজেন্সি ফ্রিকোয়েন্সি ১২১.৫…মে-ডে, মে-ডে, মে-ডে…উই লস্ট…রিকভারিং…নিড হেল্প। আমারটা না শুনলেও আশেপাশের এয়ারক্রাফট এটা শুনবে এবং সে তখন জানিয়ে দিবে যে একটা প্লেন মে ডে কল করেছে।”
এসময় তিনি জার্মানি এক বিমান দুর্ঘটনার উল্লেখ করে বলেন, “এর আগে এক জার্মান ফার্স্ট অফিসার সবাইকে নিয়ে সুইসাইড করছিলো। উনি খুব ডিপ্রেশনে ছিল।”
“বিমানের ক্যাপ্টেন বাথরুমে গেলে সে দরজা বন্ধ করে দেয়। সেই দুর্ঘটনায় পাইলটসহ সবাই মরে যায়। পরে জানা যায়, এর আগেও সে একাধিকবার সুইসাইড করার চেষ্টা করছিলো।”
সবমিলিয়ে, এমএইচ ৩৭০’র হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা এখনও এক ধোঁয়াশাই বটে।