ফাহমিদা পারভিন কর্মজীবী নারী। শিক্ষিত, সচেতন। কিন্তু হলে কী হবে, কিশোরী বয়স থেকেই পিরিয়ড নিয়ে তার বড় সংকোচ। এই বিশেষ সময়ের যত্নআত্তি নিয়ে কারও সঙ্গে আলাপ করা তো দূরের কথা, নিজে দোকানে গিয়ে কখনো প্যাডও কেনেননি।
তাঁর অষ্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়ে অরণীর বেলায়ও একই ব্যাপার ঘটছে। জড়তা ও সংকোচের কারণে মায়ের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলতে পারে না অরণী। শিক্ষিত ও কর্মজীবী নারীদের বেলায়ই যখন এই অবস্থা, তখন অন্যদের কথা না–ই বা বললাম।
পিরিয়ডকালীন স্বাস্থ্যবিধি কিংবা নিরাপদ মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে আমাদের দেশের নারীরা ঠিক কতটা সচেতন, তা সহজেই অনুমান করা যায়। অথচ পিরিয়ড বা ঋতুস্রাবের বিষয়টি নিয়ে সংকোচ, জড়তা বা লজ্জার কিছু নেই। এটি প্রত্যেক নারীর জীবনের একটি স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া।
একজন নারীর নিয়মিত ও সঠিক ঋতুস্রাব হওয়ার অর্থ, তিনি সন্তান ধারণে সক্ষম। যদিও এটি নিয়ে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি এখনো স্বাভাবিক নয়। ঋতুস্রাব চলাকালীন অপরিচ্ছন্ন ও অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের জন্য আমাদের দেশের অধিকাংশ নারী প্রস্রাবের ইনফেকশন ও জরায়ুমুখ ক্যানসারে আক্রান্ত হন।
নারীস্বাস্থ্য, বিশেষ করে নারীর প্রজননস্বাস্থ্য এবং মাসিকের সময় পরিচ্ছন্নতা বা নিরাপদ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে দুটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। একটি হচ্ছে সমাজের প্রচলিত ট্যাবু, অন্যটি স্যানিটারি প্যাডের দাম। ১০টি স্যানিটারি প্যাডের একটি প্যাকেট দরিদ্র ও সীমিত আয়ের মানুষের নাগালের বাইরে।
ইউনিসেফ বাংলাদেশ ও ওয়াটারএইডের যৌথ উদ্যোগে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সবশেষ জরিপ ‘ন্যাশনাল হাইজিন সার্ভে ২০১৮’–এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, সচেতনতার অভাব ও দাম বেশি হওয়ায় দেশের ৪৩ শতাংশ কিশোরী ডিসপোজিবল প্যাড, ৫০ শতাংশ পুরোনো কাপড় এবং বাকিরা নতুন কাপড় ও তুলা ব্যবহার করে।
প্রাপ্তবয়স্ক নারীদের মধ্যে ২৯ শতাংশ ডিসপোজিবল প্যাড ও ৬৮ শতাংশের বেশি পুরোনো কাপড় ব্যবহার করেন।
নারীস্বাস্থ্য সুরক্ষায় এবং জটিলতা এড়াতে পিরিয়ডকালীন সচেতনতা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা জরুরি। এ সময় পরিচ্ছন্ন ও সচেতন থাকুন। মেনে চলুন কিছু নিয়ম-কানুন।
• মাসিকের সময় স্যানিটারি প্যাড বা মেন্সট্রুয়াল কাপ ব্যবহার করুন। কাপড়, তুলা বা টিস্যু ব্যবহার করবেন না।
• চার থেকে ছয় ঘণ্টা পরপর স্যানিটারি প্যাড পরিবর্তন করুন। একসঙ্গে দুটি স্যানিটারি প্যাড পরবেন না।
• র্যাশ এড়াতে যথাসময়ে প্যাড পরিবর্তন করা এবং যোনিপথের আশপাশের জায়গা শুকনা রাখা জরুরি।
• ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন এড়াতে প্রতিদিন গোসল করুন। পরিষ্কার অন্তর্বাস ব্যবহার করুন।
• ব্যবহৃত কাপড় ও অন্তর্বাস পরিষ্কার করে ভালোভাবে রোদে শুকিয়ে নিন।
• যোনিপথের আশপাশে সুগন্ধী বা অ্যালকোহলযুক্ত পণ্য ব্যবহার করবেন না।
• এ সময় জরায়ুতে সংক্রমণ হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। তাই পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন থাকা জরুরি।
• ভারী কাজ, ব্যায়াম, সাঁতার বা সাইকেল চালানো থেকে বিরত থাকুন।
• হরমোনের প্রভাবে এ সময় মানসিক ও শারীরিক বেশ কিছু পরিবর্তন ঘটে। তাই মানসিক চাপ ও দুশ্চিন্তামুক্ত থাকার চেষ্টা করুন।
• এ সময় বাইরের খাবার এড়িয়ে পুষ্টিকর খাবার খান। প্রচুর পানি পান করুন।
• জটিলতা এড়াতে নিয়মিত জরায়ুমুখ ও স্তন ক্যানসার স্ক্রিনিং করা জরুরি।
অনিয়মিত পিরিয়ড
যেকোনো বয়সী নারীর অনিয়মিত ঋতুস্রাব হতে পারে। ২৮ দিনের জায়গায় ২১ থেকে ৩৫ দিন পরপর হলেও তা যদি নিয়মিত ব্যবধানে হয়, তাকেও স্বাভাবিক হিসেবে ধরা হয়। তবে ২১ দিনের আগে বা ৩৫ দিনের পর হলে এবং যদি তা ৩ দিনের কম বা ৭ দিনের বেশি স্থায়ী হয়, তখন তাকে অনিয়মিত ঋতুচক্র বলে।
অনিয়মিত পিরিয়ডের কারণ হলো—
• পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম (পিসিওএস)।
• শরীরের ওজন হঠাৎ বেড়ে যাওয়া।
• হঠাৎ ওজন কমিয়ে ফেলা।
• অতিরিক্ত মানসিক চাপ।
• জরায়ুর টিউমার।
• থাইরয়েডের সমস্যা।
• জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল ব্যবহার।
• যে মায়েরা সন্তানকে বুকের দুধ দেন।
• মাত্রাতিরিক্ত শরীরচর্চা।
• কৈশোরে ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন হরমোনের তারতম্য।
প্রতিকার
অনিয়মিত পিরিয়ড হলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন ও শরীরচর্চার দিকে গুরুত্ব দিতে হবে। পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে। মানসিক চাপমুক্ত থাকুন। রোগের কারণ নির্ণয় করার পর সঠিক চিকিৎসা নিলে আবার নিয়মিত মাসিক শুরু হবে।
লেখক: প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ, সিনিয়র কনসালট্যান্ট, ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল, ঢাকা