প্রখ্যাত কথা সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ তাঁর ‘হলুদ হিমু কালো র্যাব’ শিরোনামে একটি উপন্যাস লিখে ২০০৬ সালে বেশ শোরগোল ফেলেছিলেন। সে উপন্যাসে সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ কাল্পনিক চরিত্রের মাধ্যমে র্যাব কর্তৃক ক্রসফায়ারের প্রবণতার কথা তুলে ধরেছিলেন।
তার উপন্যাসে দুটি চরিত্রের মধ্যে র্যাব নিয়ে কথোপকথন ছিল এ রকম – “অপরাধ করেছেন কী করেন নাই এইসব বিবেচনা করবে না র্যাব। ধরা খাওয়া মানে ঢিসুম ঢিসুম। ক্রসফায়ার। আল্লাহ খোদার নাম নেন হিমু ভাই। দোয়া ইউনুস পড়তে পড়তে যান।”
র্যাব-এর কর্মকাণ্ড নিয়ে হুমায়ুন আহমেদের উপন্যাস থেকে বোঝা যায়, অতি দ্রুততার সাথে বিতর্কিত হয়ে উঠেছিল এই বাহিনী।
এ বাহিনী প্রতিষ্ঠার ২০ বছর পূর্ণ হতে যাচ্ছে আগামী ২৬শে মার্চ। কিন্তু গত ২০ বছরের বেশিরভাগ সময় জুড়ে র্যাব নিয়ে নানা বিতর্ক তৈরি হয়েছিল।
যদিও সরকারের দিক থেকে র্যাব-এর ‘সফলতা’ তুলে ধরা হচ্ছে। বুধবার র্যাবের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, “র্যাব বিভিন্ন অপরাধ দমন কিংবা কমানোর ক্ষেত্রে কাজ করেছে। কোথাও তারা অ্যাকশন নিয়েছে, কোথাও সমঝোতা করেছে কিংবা কোথাও বুঝিয়ে কাজ করেছে।”
এক্ষেত্রে তিনি সুন্দরবনের উদাহরণ তুলে ধরেন। দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় র্যাবের অপরাধ দমন নিয়েও তিনি প্রশংসা করেন।
‘ক্রসফায়ার ও জনপ্রিয়তা’
২০০১ সালের অক্টোবর মাস। নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে ক্ষমতায় আসে বিএনপি। সাথে ছিল জামায়াতে ইসলামীও।
কিন্তু ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমাবনতি হতে থাকে। ঢাকার রাস্তায় একের পর হত্যাকাণ্ড ঘটতে থাকে, যাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন ওয়ার্ড কমিশনারও ছিলেন।
পরিস্থিতি সামাল দিতে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ‘অপারেশন ক্লিনহার্ট’ শুরু হয় ২০০৩ সালের অক্টোবর মাসে।
এরপর ২০০৪ সালের জানুয়ারি মাসে সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফিরে যাবার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য একটি পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন অনেকে।
এমন প্রেক্ষাপটে ২০০৪ সালের ২৬শে মার্চ কার্যক্রম শুরু করে ‘র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন’ বা র্যাব। অবশ্য এর প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল আরো আগে থেকেই।
র্যাব কার্যক্রম শুরু করার পর সেটি আপাতত জনমনে কিছুটা স্বস্তি এনেছিল। তাৎক্ষণিকভাবে দেশের বিভিন্ন স্থানে অপরাধ কার্যক্রম ও চাঁদাবাজি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসে।
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন বা র্যাবের বন্দুকযুদ্ধের সূচনা হয় পিচ্চি হান্নানের ‘ক্রসফায়ারের’ মধ্য দিয়ে।
সে সময় অনেক কুখ্যাত সন্ত্রাসী র্যাবের সঙ্গে ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত হওয়ায় রাতারাতি র্যাব ‘জনপ্রিয়’ হয়ে ওঠে।
সেই সময় কিছু ‘ক্রসফায়ারের’ পর বিভিন্ন এলাকায় মিষ্টি বিতরণের ঘটনাও ঘটেছে।
বিতর্ক পিছু নেওয়া
বাহিনী হিসাবে র্যাব সবচেয়ে সমালোচনার মুখে পড়েছে তথাকথিত ‘ক্রসফায়ারে’র কারণে।
বাংলাদেশে পুলিশের সঙ্গে এর আগেও বন্দুকযুদ্ধে সন্ত্রাসীদের হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। তবে র্যাবের সঙ্গে ‘ক্রসফায়ার’ যেন এক সময় অনেকটা নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়।
মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের তথ্য অনুযায়ী, শুরুর সময় থেকে বিএনপির ক্ষমতার মেয়াদ ২০০৬ সালে শেষ হওয়া পর্যন্ত র্যাবের সাথে বন্দুক যুদ্ধে ৩৮০জন নিহত হয়েছে।
র্যাবের কর্মকাণ্ড তখন থেকেই বিদেশিদের নজরে আসতে থাকে। ঢাকায় নিযুক্ত তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ওয়াশিংটনে যে তারবার্তা পাঠিয়েছিলেন সেখানে এ চিত্র ফুটে ওঠে।
মার্কিন তারবার্তায় বলা হয়েছিল, ”র্যাবের সবচেয়ে পরিচিত বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ক্রসফায়ার নামের বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, যার কারণে পথঘাট নিরাপদ হয়ে উঠেছে বলে তারা দাবি করেছে। প্রতিবারের গল্প প্রায় একই রকম।”
‘ক্রসফায়ার’ ছাড়াও র্যাবের বিরুদ্ধে ঘুষ, চাঁদা নেওয়া কিংবা অন্যের হয়ে জমি দখল করার মতো নানা অভিযোগও দানা বাঁধতে থাকে।
র্যাব নিয়ে বিশ্লেষণে ২৩শে অগাস্ট, ২০০৫ সালের মার্কিন তারবার্তায় বলা হয়েছে, র্যাবের কোনও কোনও সদস্যের বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়া, চাঁদা আদায় করা, এমনকি ডাকাতির অভিযোগও উঠেছে।
সেই সময়কার স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর হুঁশিয়ারি জানিয়ে বলেছিলেন, ”যদি কোনও র্যাব সদস্য বিশৃঙ্খলা করে, তার বিরুদ্ধে সরকার কঠোর ব্যবস্থা নেবে।”
বড় বিতর্ক
বিভিন্ন সময় নিয়মিত বিরতিতে র্যাবের হাতে ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত হবার খবর প্রকাশিত হতে থাকে। এসব ঘটনায় সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগ ওঠে যে অর্থের বিনিময়ে অন্যের হয়ে হত্যাকাণ্ড চালিয়ে সেটিকে ‘ক্রসফায়ার’ বলে চালিয়ে দিচ্ছে র্যাব।
এ ধরনের একটি বড় ঘটনা প্রকাশ্যে চলে আসে ২০১৪ সালে। নারায়ণগঞ্জে সাতজনকে হত্যা করে শীতলক্ষ্যা নদীতে ডুবিয়ে দেবার অভিযোগ ওঠে। এসব মৃতদেহ ভেসে ওঠার পর বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে।
খুন হওয়া একজন পৌর কাউন্সিলর নজরুল ইসলামের পরিবার অভিযোগ করে, পুলিশের বিশেষ বাহিনী র্যাব তাকে তুলে নিয়ে হত্যা করেছে।
এক সংবাদ সম্মেলনে মি. ইসলামের শ্বশুর শহীদুল ইসলাম অভিযোগ করেছিলেন, র্যাবের কর্মকর্তাদেরকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ঘুষ দিয়ে তার জামাতাকে খুন করানো হয়েছে।
এ ঘটনায় জড়িত র্যাবের একজন সিনিয়র কর্মকর্তাসহ ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রাখে হাইকোর্ট। যদিও বিষয়টি এখনো আপিল বিভাগে নিষ্পত্তি হয়নি।
সাবেক পুলিশ প্রধান এ কে এম শহীদুল হক বিবিসি বাংলাকে বলেন, র্যাবের কাজে মানুষ খুশি ছিল। এবং অপরাধ দমনের ক্ষেত্রে তারা পুলিশের পাশাপাশি কাজ করেছে।
“২০০৪ সালে র্যাব প্রতিষ্ঠার পর থেকে কিছু কথাবার্তা উঠছে – ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার। ওগুলো মানুষ লুফে নিয়েছিল। প্রথম অবস্থায় যারা সন্ত্রাসী ও শীর্ষ সন্ত্রাসী – এ ধরণের মানুষ যখন ক্রসফায়ার ও এনকাউন্টারে মারা গেছে, জনগণ তখন খুশি ও ওয়েলকাম জানাইছে।”
“বিতর্ক নাই কাকে নিয়ে? কেউ কি বিতর্কের ঊর্ধ্বে আছে?” – প্রশ্ন তোলেন মি. হক।
বিতর্কের শেষ পেরেক
র্যাবের বিরুদ্ধে বিতর্ক আরো জোরালো হয় ২০১৮ সালে টেকনাফে পৌর কাউন্সিলর ও স্থানীয় যুবলীগের সাবেক সভাপতি মো. একরামুল হকের নিহত হওয়ার ঘটনা নিয়ে রেকর্ড করা অডিও প্রকাশ হওয়ার পর। দেশের কিছু সংবাদমাধ্যমে সেটি প্রকাশও হয়েছিল।
সেই অডিওতে শোনা যাচ্ছে যে, একরামুল হকের নিহত হওয়ার ঘটনার সময় এবং তার আগ মুহুর্তে ঘটনাস্থলে মোবাইল ফোনে তিনবার কল এসেছিল।
শেষ ফোন কলটি রিসিভ হলেও ঘটনাস্থল থেকে ফোনটিতে কেউ উত্তর দিচ্ছে না।
যিনি ফোন করেছেন, প্রথমে তার কিছুটা কথা আছে। কিন্তু পরে ঘটনাস্থল বা সেই প্রান্ত থেকে একটা ভয়াবহ পরিবেশের চিত্র পাওয়া যায় এই অডিওতে।
একরামুল হকের স্ত্রী আয়শা বেগম তখন বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ঘটনার আগ মুহুর্তে তার দুই মেয়ে প্রথমে মি. হকের মোবাইল ফোনে কল করে তার সাথে অল্প সময় কথা বলেছিল। এই কথোপকথনে পরিস্থিতি গুরুতর মনে হওয়ায় সাথে সাথে আয়শা বেগম নিজে ফোন করেন।
তার ফোন কলটি রিসিভ করা হয়, কিন্তু অপর প্রান্ত থেকে কোনও জবাব পাননি। তিনি গুলি এবং ঘটনাস্থলের সব শব্দ শুনতে পেয়েছেন।
সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা মি. হক মনে করেন, কয়েকটি ঘটনা দিয়ে একটি বাহিনীর পুরো কর্মকাণ্ড বিচার করা ঠিক হবে না।
“দুই একটা দুর্ঘটনা যে ঘটে নাই তা তো না। দুর্ঘটনা তো দুই চারটা ঘটছে। বিতর্কের চেয়ে যে বেশি সফলতা-অর্জন সেটা তো খাটো করে দেখে না মানুষ”, বলছিলেন মি. হক।
রাজনৈতিক ব্যবহার
র্যাবের বিরুদ্ধে আরেকটি গুরুতর অভিযোগ আসে সরকার-বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের তুলে নেওয়া।
বিশেষ করে ২০১৪ সাল এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে ও পরে এ ধরনের ঘটনার বেশ কিছু অভিযোগ সংবাদ মাধ্যমে এসেছিল।
মানবাধিকার সংগঠন ‘মায়ের ডাক’-এর সানজিদা আক্তার বিভিন্ন সময় অভিযোগ করেছেন, ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে তার ভাই ও বিএনপি নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমন এবং আরো কয়েকজনকে র্যাব তুলে নিয়ে যায়। তাদের খোঁজ এখনো পর্যন্ত মেলেনি।
র্যাব সব সময় এসব অভিযোগ অস্বীকার করলেও সেটি দেশে-বিদেশে মানবাধিকার কর্মীদের কাছে সন্তোষজনক মনে হয়নি।
সাবেক পুলিশ প্রধান মি. হক মনে করেন, রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের বিষয়টা ‘অস্পষ্ট’ একটি বিষয়।
“রাজনীতিবিদরা যদি ব্যক্তিগত স্বার্থে কোনও বাহিনীর কোনও সদস্যকে ব্যবহার করে, সেটা বিচ্ছিন্নভাবে করতে পারে। কিন্তু সেটা তো সার্বিক বিষয় না”, বলছিলেন শহিদুল হক।
আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা
অনেকটা আকস্মিকভাবে ২০২১ সালের ১০ই ডিসেম্বর আমেরিকার দিক থেকে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয় র্যাব বাহিনী এবং এর ছয়জন কর্মকর্তার উপর। সেখানে ‘গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের’ অভিযোগ আনা হয়।
বিজ্ঞপ্তিটিতে বলা হয়, বাংলাদেশের বেসরকারি সংগঠনগুলো অভিযোগ করেছে যে র্যাব এবং অন্যান্য আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা ২০০৯ সাল থেকে প্রায় ৬০০টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, ৬০০-রও বেশি লোকের অদৃশ্য হয়ে যাওয়া, এবং নির্যাতনের জন্য দায়ী।
অবশ্য আমেরিকা নিষেধাজ্ঞা দেবার পর থেকে গত দুই বছরে র্যাব-এর হাতে ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত হবার ঘটনা নেই বললেই বললেই চলে।
র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞার বিষয়টিকে ‘কালো দাগ’ হিসেবে হিসেবে বর্ণনা করেন শহীদুল হক।
“যে কারণ দেখিয়ে স্যাংশন দেওয়া হয়েছে সেটা আমাদের জন্য একটি বদনাম।”
ভবিষ্যত কী?
র্যাব-এর ওপর নিষেধাজ্ঞা দেবার দুই বছর পার হলেও তাদের কর্মকাণ্ড এখনো স্বাভাবিক নিয়মেই চলছে। কোনও ধরনের নেতিবাচক প্রভাব এখনো দৃশ্যমান হয়নি।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে বিভিন্ন সময় বলা হয়েছে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের জন্য তারা যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সাথে আলোচনা অব্যাহত রেখেছে।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা নিয়ে বুধবার র্যাবের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে আবারো উষ্মা প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি র্যাব এর জঙ্গি বিরোধী কর্মকাণ্ডের জন্য তাদের প্রশংসা করেন।
“যারা আমাদের জঙ্গিবাদ সন্ত্রাস, জলদস্যু, বনদস্যু এদের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করা বা মানুষের অধিকার সংরক্ষণে যারা কাজ করেছে, তাদের উপর কীভাবে স্যাংশন আসে? তাদের অপরাধটা কী?” – প্রশ্ন তোলেন শেখ হাসিনা।
“আমাদের দেশের, আমাদের সংস্থা তারা দেশের মানুষের নিরাপত্তা দেবার জন্য যখন কোনও অপরাধী শনাক্ত করবে, ধরবে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে – সেজন্য অন্য আরেকটি দেশ এসে স্যাংশন দেবে এটা আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।”
“প্রথম প্রথম অনেকে ঘাবড়ে দিয়েছিল। আমি বলেছি, ঘাবড়ানোর কিছু নেই। স্যাংশন কখনো একতরফা হয় না। দরকার হলে আমরাও স্যাংশন দিতে পারি, সে অধিকারও আমাদের আছে,” বলেন শেখ হাসিনা।