ইয়েমেনের দক্ষিণাঞ্চলে একটি পণ্যবাহী জাহাজে হুথিদের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় তিন জন ক্রু নিহত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা বলছেন, বাণিজ্যিক জাহাজগুলোতে এই গোষ্ঠীটির হামলা শুরুর পর থেকে প্রথম প্রাণহানির ঘটনা এটি।
বার্বাডোজের পতাকাবাহী ট্রু কনফিডেন্স নামের জাহাজটি খালি করা হয়েছে এবং আগুন নিয়েই জাহাজটি ভেসে চলেছে।
কার্গো জাহাজে হুথি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা
মার্কিন সামরিক বাহিনী বলছে, গ্রিনিচ মান সময় সাড়ে এগারোটায় এডেন উপসাগরে এই হামলা চালানো হয়।
হুথিরা বলেছে, গাজায় চলমান ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যকার যুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের প্রতি সমর্থন হিসেবে এই হামলা চালানো হয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যে পরিচালিত অভিযানগুলোর বিষয়ে নজরদারি করা প্রতিষ্ঠান যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রাল কমান্ড (সেন্টকম) বলেছে, জাহাজের তিনজন ক্রু নিহত হয়েছে এবং আরো চারজন আহত হয়েছে যাদের মধ্যে তিন জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে করা এক পোস্টে প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, “হুথিদের এ ধরনের বেপরোয়া হামলা বৈশ্বিক বাণিজ্যকে ব্যাহত করেছে এবং আন্তর্জাতিক নাবিকদের জীবন কেড়ে নিয়েছে।”
এক বিবৃতিতে ইরান সমর্থিত গোষ্ঠীটি বলেছে, ট্রু কনফিডেন্স নামে ওই জাহাজটির নাবিকরা হুথি নৌ বাহিনীর দেয়া সংকেত উপেক্ষা করেছে।
ইয়েমেনে থাকা ব্রিটিশ দূতাবাস বলেছে, নাবিকদের মৃত্যু “দুঃখজনক কিন্তু আন্তর্জাতিক জাহাজ চলাচলের উপর হুথিদের বেপরোয়া ক্ষেপণাস্ত্র হামলার এমন পরিণতি হওয়ারই কথা ছিল।”
এই ধরনের হামলা বন্ধ হওয়া উচিত বলেও বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়।
জাহাজটিতে ২০ জন ক্রু ছিলেন। এর মধ্যে একজন ভারতীয়, ভিয়েতনামের চার জন এবং ১৫ জন ফিলিপিন্সের নাগরিক। এছাড়া জাহাজে তিন জন সশস্ত্র প্রহরী ছিলেন যাদের মধ্যে শ্রীলঙ্কার দুইজন এবং নেপালের একজন নাগরিক রয়েছেন।
এক বিবৃতিতে জাহাজের মালিক ও ব্যবস্থাপকদের মুখপাত্র বলেন, ইয়েমেনি শহর এডেন থেকে ৫০ নটিক্যাল মাইল দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে এই হামলা হয়।
এই হামলার পর হুথিদের পরিচালিত আল-মাসিরাহ টিভি বুধবার সন্ধ্যায় তাদের এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে যে, হুথিদের নিয়ন্ত্রিত লোহিত সাগরের বন্দর নগরী হুদায়দাহ এর একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর লক্ষ্য করে যুক্তরাষ্ট্র দুটি বিমান হামলা চালিয়েছে।
যুক্তরাজ্যের মেরিটাইম ট্রেড অপারেশন সংস্থা-ইউকেএমটিও- এর তথ্য অনুযায়ী, ট্রু কনফিডেন্স জাহাজটিকে ভিএইচএফ রেডিওর মাধ্যমে একটি গোষ্ঠী পথ পরিবর্তন করতে বলেছিল। ওই গোষ্ঠীটি নিজেদেরকে ‘ইয়েমেনি নৌবাহিনী’ হিসেবে পরিচয় দিয়েছিল।
পরে কাছাকাছি থাকা আরেকটি জাহাজ থেকে প্রচণ্ড জোরে শব্দ শুনতে পাওয়ার পর ধোঁয়া দেখা গেছে বলে জানায় তারা।
ইউকেএমটিও জানায়, ট্রু কনফিডেন্সে হামলা হয়েছে এবং বেশ ক্ষতি সাধিত হয়েছে। পরে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক নৌচলাচল বিষয়ক যৌথ বাহিনী ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম কোয়ালিশন তাদের সহায়তায় এগিয়ে আসে।
হর্ন অব আফ্রিকা নামে ইইউ এর নৌ চলাচল সুরক্ষা কেন্দ্র জানায়, উদ্ধার অভিযান চলছে।
হুথিরা এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ট্রু কনফিডেন্স একটি আমেরিকান জাহাজ। তবে মুখপাত্র বলেছে যে, জাহাজটির “বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো সংস্থার সাথে কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।”
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেছে, ওয়াশিংটন হামলার জন্য হুথিদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার ব্যবস্থা করে যাবে এবং বিশ্বের অন্য সরকারগুলোকেও একই ধরনের পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানানো হয়।
ম্যাথিউ মিলার বলেন, “হুথিরা লোহিত সাগরে চলাচলকারী নিরীহ বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষার কথা বিবেচনা না করেই এ ধরনের বেপরোয়া হামলা চালিয়ে যাচ্ছে এবং তারা এখন দুর্ভাগ্যবশত এবং দুঃখজনকভাবে বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা করছে।”
যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড ক্যামেরন বলেন, “আন্তর্জাতিক জাহাজ চলাচলের ওপর হুথিদের বেপরোয়া ও নির্বিচার হামলার নিন্দা জানাই আমরা এবং এগুলো বন্ধেরও দাবি জানাই।”
সামাজিক মাধ্যমে লেখা এক পোস্টে তিনি বলেন, “চলাচলের স্বাধীনতার পক্ষে আমরা সব সময় থাকবো এবং আমাদের প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন হিসেবে পদক্ষেপও নিবো আমরা।”
এক বিবৃতিতে জাহাজটির মালিক ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ট্রু কনফিডেন্স জাহাজটির মালিক ট্রু কনফিডেন্স শিপিং এসএ যেটি লাইবেরিয়ার একটি ঠিকানায় নিবন্ধিত। এটি পরিচালনা করে থার্ড জানুয়ারি মেরিটাইম লিমিটেড নামে গ্রিসের একটি সংস্থা।
বার্তা সংস্থা এপি এর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, এই জাহাজটি এর আগে যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক ওকট্রি ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট নামে একটি সংস্থার মালিকানায় ছিল। ওকট্রি এ বিষয়ে এপির সাথে কথা বলতে রাজি হয়নি।
এক মুখপাত্র জানান, জাহাজটি চীনের লিয়ানইয়ুনগ্যাং থেকে সৌদি আরবের জেদ্দার উদ্দেশে যাচ্ছিল এবং এতে স্টিল পণ্য ও ট্রাক ছিল।
ব্রিটিশ দূতাবাস বলছে, এডেন উপসাগর ও লোহিত সাগরে জাহাজ চলাচল লক্ষ্য করে হুথিদের গত প্রায় চার মাস ধরে চলা ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলার জের ধরে এ ধরনের একটি প্রাণহানি অনেকটা অবশ্যম্ভাবীই ছিল।
ওই এলাকায় থাকা যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন নৌবাহিনী টাস্কফোর্স এ ধরনের ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র গুলি করে ভূপাতিত করে আসছিল। কিন্তু এসব হামলার সংখ্যা এতো বেশি ছিল যে তাদের পক্ষে প্রতিটি ক্ষেপণাস্ত্র ভূপাতিত করাটা সম্ভব ছিল না।
হুথিদের কাছে অস্ত্র সরবরাহের কমতি নেই বলে মনে হচ্ছে। এর ফলে হুথিদের হামলা পরিচালনা করার স্থান, গোলাবারুদের মজুদ এবং কমান্ড ও কন্ট্রোল পোস্ট লক্ষ্য করে যুক্তরাষ্ট্র যে বিমান হামলা চালিয়ে আসছে তার কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
হুথিদের হামলাগুলো যেহেতু এখন প্রাণঘাতী হয়ে উঠেছে তাই তাদের দমন করতে ইয়েমেনের ভেতরে তাদের লক্ষ্য করে চালানো হামলার পরিসর বাড়ানোহতে পারে। তবে এর ফলে গাজার মানবেতর পরিস্থিতির কারণে এরইমধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠা অঞ্চলটিতে উত্তেজনা আরো বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
হুথিরা বলছে, ফিলিস্তিনিদের প্রতি সমর্থন হিসেবে এসব হামলা চালাচ্ছে তারা। জাহাজ চলাচলের ওপর হুথিদের এই হামলা জরুরি ভিত্তিতে বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, বাহরাইন এবং অন্য আরো কয়েকটি দেশ।
মঙ্গলবার ইয়েমেন থেকে ইউএসএস কার্নিকে লক্ষ্য করে ছোড়া একটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও তিনটি ড্রোনকে গুলি করে ধ্বংস করেছে মার্কিন বাহিনী। এরপর আরো তিনটি জাহাজ বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র ও তিনটি সামুদ্রিক ড্রোন ছোড়া হয়।
এদিকে সোমবার ভারতীয় নৌবাহিনী এমএসসি স্কাই টু নামে একটি কন্টেইনারবাহী জাহাজের আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সহায়তা করে। জাহাজটির পরিচালনাকারীরা জানিয়েছেন, সেটিকে একটি ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত করেছিল। তবে এতো কেউ হতাহত হয়নি এবং আগুনটিও ছোট ছিল।
রোববার রুবিমার নামে বেলিজের পতাকাবাহী একটি কার্গো জাহাজ লোহিত সাগরে ডুবে গেছে। দুই সপ্তাহ আগে এই জাহাজটিকে হুথিদের একটি ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত করেছিল। গত নভেম্বরে হুথিদের হামলা শুরু হওয়ার পর থেকে ডুবে যাওয়া এটাই প্রথম জাহাজ।
হামলা চালানোর সময় রুবিমার জাহাজটি এডেন উপসাগরকে লোহিত সাগরের সাথে সংযোগকারী বাব এল-মান্দেব প্রণালীর কাছে ছিল। ক্রুদের সবাইকে উদ্ধার করা হয় এবং জাহাজটি ধীরে ধীরে পানিতে তলিয়ে যেতে থাকে।
জাহাজটিতে প্রায় ২১ হাজার মেট্রিক টন অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট সার ছিল। মার্কিন সামরিক বাহিনী বলছে, এটি লোহিত সাগরের পরিবেশগত ঝুঁকি তৈরি করার আশঙ্কা রয়েছে।