মিয়ানমারের রাখাইনে গৃহযুদ্ধের প্রভাবে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের চেষ্টা রয়েছে। কিন্তু কোনোভাবেই যেন মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আর কেউ ঢুকতে করতে না পারে সেজন্য কঠোর অবস্থান নিয়েছে বাংলাদেশ।
সেজন্য মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তে সার্বক্ষণিক নজরদারির সঙ্গে অতিরিক্ত কড়াকড়ি এবং বাড়তি সতর্কতা নেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সীমান্তের ২৭১ কিলোমিটারের মধ্যে একটা বড় অংশ বিভাজিত করেছে নাফ নদ। দুই দেশের সীমানা নির্ধারণকারী নাফ নদে সতর্ক অবস্থান নিয়েছে দুটি বাহিনী। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ বা বিজিবি এবং কোস্ট গার্ড যৌথভাগে নাফ সীমান্ত পাহারা দিচ্ছে।
সরেজমিনে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে গিয়ে মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকায় সীমান্তরক্ষী মোতায়েন এবং নজরদারির ক্ষেত্রে বাড়তি মনোযোগ লক্ষ্য করা গেছে।
স্থানীয়রা বলছেন, নাফ নদে কোস্ট গার্ড এবং বিজিবির টহল বেড়েছে আবার স্থলভাগেও অতিরিক্ত বিজিবি সদস্য মোতায়েন করতে দেখা যাচ্ছে।
বাড়তি সতর্কতা
রাখাইনে গৃহযুদ্ধের প্রভাবে মিয়ানমার বাংলাদেশ সীমান্তে এখনো থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
সীমান্তের ওপারে গোলাগুলি কিছুটা কমেছে, কিন্তু এখনো পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। রাখাইন রাজ্যের অনেক এলাকা বিদ্রোহী আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে।
এখন জান্তা বাহিনী নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য জোরালো পাল্টা আক্রমণ করলে বাংলাদেশে নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ হতে পারে এমন উদ্বেগ কাজ করছে।
সীমান্তে দায়িত্বরত সৈন্যদের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক কথা বলে বোঝা গেছে সেখানে নতুন করে অনেক সৈন্য মোতায়েন করা হয়েছে।
সবমিলিয়ে যে ধারণা পাওয়া গেছে তাতে মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তে বিজিবি ও কোস্ট গার্ডের জনবল অন্তত দ্বিগুণ করা হয়েছে।
কিন্তু সীমান্ত পরিস্থিতিতে চলমান তৎপরতা সম্পর্কে বিজিবি এবং কোস্ট গার্ড কেউ কোনো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দেয়নি।
সীমান্ত এলাকায় কোস্ট গার্ড তাদের নৌ-যান এবং টহলের দিকটি পরিদর্শনের সুযোগ দিলেও বিজিবি এক্ষেত্রে কঠোর গোপনীয়তা এবং কড়াকড়ি আরোপ করেছে।
সীমান্তে যে অভিজ্ঞতা
নিরাপত্তার স্বার্থে সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিজিবি এখন কোনোভাবেই সীমান্তের কাছাকাছি কাউকে যেতে দিচ্ছে না।
সাংবাদিকদেরও সেখানে সীমান্তবর্তী গ্রামে প্রবেশে বাধা দেয়া হচ্ছে। বিবিসির সাংবাদিক তমব্রু বাজারে ইউনিয়ন পরিষদে যেতে চাইলে বাইশফাঁড়ী বিওপি থেকে ফিরিয়ে দেয়া হয়।
সীমান্ত এলাকা এখনও নিরাপদ নয় এবং নিরাপত্তার স্বার্থে সাংবাদিকদের সেখানে প্রবেশাধিকার সীমিত করা হয়েছে বলেই জানানো হয়েছে।
ঘুমধুম সীমান্ত বিওপির কাছে গেলে সেখানেও সীমান্ত এলাকার ছবি তোলা এবং গাড়ি নিয়ে অবস্থান করতে দেয়া হয়নি।
বিধি-নিষেধ এবং সতর্কতার বিষয়ে দায়িত্বরত সৈন্যরা প্রত্যেকেই জানিয়েছেন তাদের উপর থেকে কড়া নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
কক্সবাজার রিজিওনাল কমান্ডারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও সদরদপ্তরের অনুমতি ছাড়া কোনো বক্তব্য দিতে অপারগতা তিনি জানান।
বিজিবি সদরদপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে সীমান্ত নিরাপত্তা ইস্যুতে এই মুহূর্তে কোনো বক্তব্য দেয়া সম্ভব নয় বলে বিবিসিকে জানানো হয়েছে।
সংকট কোথায়?
টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ সংলগ্ন উপকূল অংশে মাদক ও চোরাচালান প্রতিরোধ করা কোস্ট গার্ড ও বিজিবির সবসময় বড় অগ্রাধিকার।
এর সঙ্গে বর্তমানে মিয়ানমার থেকে যে কোন ধরণের অনুপ্রবেশ ঠেকানো বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়েছে।
এর কারণ হিসেবে জানা যায় সরকারের কঠোর নির্দেশনা যেমন আছে তেমনি সীমান্ত এলাকায় অবৈধ অনুপ্রবেশের চেষ্টাও অব্যাহত রয়েছে।
শাহপরী জেটি ঘাটে জেলে নৌকার পাহারাদার নূর হোসেন বলছিলেন, রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশের চেষ্টা থেমে নেই। গত সপ্তাহে নৌকায় বড় একটি দল ঢোকার চেষ্টা করেছিল।
মি. হোসেনের হিসেবে ছোট নৌকায় করে ৩০-৩৫ জনের মতো একটি দল এসেছিল যাদেরকে পরে তাদের মংডু এলাকা দিয়ে মিয়ানমারে ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।
বিজিবি ও কোস্ট গার্ডের দায়িত্বশীল কেউ বক্তব্য না দেয়ায় নূর হোসেনের দাবির বিষয়টিও যাচাই করা সম্ভব হয়নি।
রাখাইনে গৃহযুদ্ধের কারণে গত এক মাসে সীমান্ত দিয়ে কতজন বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টা করেছে এবং তাদের কতজনকে ফেরত পাঠানো হয়েছে এ নিয়ে বিজিবি বা কোস্ট গার্ডের কাছ থেকে কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। ।
তবে টেকনাফ বিজিবি অধিনায়কের বরাত দিয়ে ২২শে ফেব্রুয়ারি রোহিঙ্গাদের নয় সদস্যকে পুশব্যাক করার খবর স্থানীয় গণমাধ্যমে এসেছে।
নূর হোসেন বলেন যারা বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টা করেছিল সেখানে নারী পুরুষদের দেখে রোহিঙ্গা বলেই মনে হয়েছে।
শাহপরীর দ্বীপ এলাকায় কোস্ট গার্ড এবং বিজিবি যেভাবে তৎপর রয়েছে আগে কখনো এতটা সতর্ক এবং হুশিয়ার দেখেননি বলে জানান নূর হোসেন।
মিয়ানমারে আরাকান আর্মির ওপর হামলা হলে সেখান থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করলে সীমান্তে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বজায় রাখা কঠিন হবে বলে মনে করেন বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) আ. ল. ম. ফজলুর রহমান।
বিবিসি বাংলাকে মি. রহমান বলেন, মিয়ানমারের সঙ্গে স্থল সীমান্তের ১৬৪ কিলোমিটার অংশ দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় সবখানে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।
“বিজিপির তিনশ জন এবং দুই জন আর্মি তারা যে বাংলাদেশে ঢুকলো এটাতো তারা বর্ডার ক্রস করেই এসেছে। বিজিবি তো তাদের ঠেকাতে পারেনি।”
মি. রহমানের কথায়, “বান্দরবান এলাকায় যদি আপনি যান সেখানে যে গভীর জঙ্গল সেখানে কিন্তু বিজিপিরও লোক নাই আমাদেরও কিন্তু নাই। ওই এলাকাগুলোতে যদি কোনো মানুষ অবস্থান নিয়ে থাকে, এদেরকে ফ্ল্যাশ আউট করা কিন্তু খুব মুশকিল।”
“মিয়ানমার সীমান্ত এলাকা অবশ্যই দুর্গম এবং এই এলাকাটা আমরা এর আগে ওইরকম গুরুত্ব দেইনি যতখানি দেয়া উচিৎ ছিল। কেননা মিয়ানমার থেকে যখন ২০১৭ সালে রোহিঙ্গারা আসলো তখন যদি কাঁটাতারের বেড়া দেয়া হতো তাহলে কিন্তু সুবিধা হতো।
কিন্তু সেটা আমরা করিনি। করলে কিন্তু এখন যেটা ঘটছে এটা হয়তো ঘটতো না এবং বিজিবির পক্ষে বর্ডার গার্ড করতে সুবিধা হতো।”
বিজিবির জন্য আরেকটি সংকট হলো সীমান্তের ওপারের এলাকা এখন বিদ্রোহী আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে।
কিন্তু আরাকান আর্মির সঙ্গে বিজিবির কোনো প্রকাশ্য যোগাযোগ নেই। দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে যে কোনো সমস্যা সৃষ্টি হলে যে যে পতাকা বৈঠক হয় বিজিবি এখন সেটি করতে পারবে না আনুষ্ঠানিকভাবে।
সাবেক মহাপরিচালক ফজলুর রহমান বলছেন, সরকারি নির্দেশনা ছাড়া এই যোগাযোগের ম্যান্ডেট বিজিবির নেই।
“বিজিবির এরকম কোনো ম্যান্ডেট নাই যে রাষ্ট্রীয়ভাবে তারা আরাকান আর্মির সাথে যোগাযোগ করতে পারে। এটা সরকারকেই এটার ব্যবস্থা নিতে হবে,” বলেন ফজলুর রহমান।
সর্বশেষ মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্ত পরিদর্শন করতে গিয়ে বিজিবির বর্তমান মহাপরিচালক জানিয়েছিলেন সীমান্ত নজরদারি করতে সক্ষমতা বৃদ্ধি হয়েছে। এখন উন্নত প্রযুক্তির সহায়তায় সীমান্তে নজরদারি করতে সক্ষম বিজিবি।
উৎসঃ বিবিসি