ছাত্ররাজনীতি ইস্যুতে আবারো উত্তপ্ত বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)। সাড়ে চার বছর আগে ছাত্রলীগের কর্মীদের হাতে এক ছাত্র নিহত হওয়ার শিক্ষার্থীদের তীব্র আন্দোলনে রাজনীতি নিষিদ্ধ হয় বুয়েটে। এতদিন পর হঠাৎই আবার একই দাবিতে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে বুয়েট ক্যাম্পাস।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ থাকলেও গত বুধবার মধ্যরাতে আবারো ছাত্রলীগের সদস্যরা বহিরাগতদের নিয়ে এসে ক্যাম্পাসে প্রোগ্রাম করেছে। যে কারণে ক্লাস পরীক্ষা বর্জন করে আন্দোলনে নেমেছেন তারা।
এ ঘটনার পরদিনই ক্যাম্পাসে আন্দোলন শুরু করে শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে ছয় দফা দাবি বাস্তবায়নে আল্টিমেটাম দেয় তারা। এ দাবি বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত ক্লাস পরীক্ষা বর্জন চালিয়ে যাওয়ার কথাও জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বক্তব্য হচ্ছে, শিক্ষার্থীদের কিছু দাবি তারা মেনেছেন। একই সাথে ঐদিন কী ঘটেছিলো তা তদন্তে তারা কমিটিও গঠন করেছেন। কমিটির রিপোর্ট পেয়ে তারা ব্যবস্থা নেবেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সত্য প্রসাদ মজুমদার শনিবার দুপুরে সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, “ছাত্রদের দাবির বিষয়ে ভিডিও ফুটেজ দেখে ব্যবস্থা নেয়া হবে। নিয়ম অনুযায়ী অভিযুক্তদের শাস্তি দেওয়া হবে”।
যদিও শিক্ষার্থীদের বক্তব্য এই দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলনের মাঠ ছাড়ছেন না তারা। শনিবার দিনভর বিক্ষােভের পর শিক্ষার্থীরা রোববার সকাল থেকে আবারো আন্দোলন কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।
এর জবাবে ছাত্রলীগ বলছে, শিক্ষার্থীরাদের একটি অংশ ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে এ ধরনের আন্দোলন করছে। এই আন্দোলন স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তির আন্দোলন বলেও মনে করে ছাত্রলীগ।
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান বিবিসি বাংলাকে বলেন, “ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন সেহেরি খেতে যাওয়ার পথে বুয়েট ক্যাম্পাসে দাঁড়িয়েছিলেন। বুয়েট ক্যাম্পাসে দাড়িয়ে থাকা তো কোন অপরাধ হতে পারে না। এটা তো কোন রাজনৈতিক কর্মসূচিও নয়।”
যে কারণে আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা
২০১৯ সালে আবরার ফাহাদ নামে এক শিক্ষার্থীকে পিটিয়ে হত্যা করে বুয়েট ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। পরে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ হয় বুয়েটে। এরপর গত কয়েক বছরে ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতির কার্যক্রম বন্ধ ছিলো।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বিবিসি বাংলাকে জানান, গত ২৮ মার্চ রাত ১টার দিকে সাধারণ শিক্ষার্থীরা জানতে পারেন বুয়েটে ছাত্রলীগের বেশ কজন শীর্ষস্থানীয় নেতা এসেছেন এবং তাঁরা ক্যাম্পাসের মেইন গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকেছেন।
শিক্ষার্থীদের দাবি, সেখানে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেনসহ বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী ছিলেন। তারা ক্যাম্পাসে ঢোকার পর তাদের ফুল দিয়ে বরণ করা হয়। সেখানে সংক্ষিপ্ত একটি অনুষ্ঠানও হয়।
চতুর্থ বর্ষের এক ছাত্রী বিবিসি বাংলাকে বলেন, “ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের ক্যাম্পাসে অনুপ্রবেশ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মের বাইরে। আমরা নিজেরাই সাড়ে দশটার পর ক্যাম্পাসে ঢুকতে পারি না। ওখানে তারা ঢুকে কিভাবে এমন একটি প্রোগ্রাম করলো?
শিক্ষার্থীরা বলছেন, ছাত্রলীগে মধ্যরাতে বুয়েট ক্যাম্পাসে অনানুষ্ঠানিকভাবে যে শোডাউন ও প্রোগ্রাম করেছে সেখানে সাধারণ কিছু শিক্ষার্থীও ছিলো।
বুয়েটের যে সব শিক্ষার্থীদের সাথে বিবিসি বাংলার কথা হয়েছে তারা কেউ তাদের নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি নিরাপত্তার স্বার্থে।
তারা জানান, ওই দিন রাত একটার পর থেকে একের পর এক বহিরাগত রাজনৈতিক নেতাকর্মী মোটরসাইকেল, প্রাইভেট কার নিয়ে ক্যাম্পাসের মেইন গেটের সামনে আসতে থাকে। তারা অনায়াসে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে থাকে।
বহিরাগতসহ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতারা যখন আসছিলেন তখন সেখানে বিশাল একটি বহর হাতে ফুলের তোড়া নিয়ে ক্যাম্পাসে রাত ২টার পর ঢুকতে থাকে বলে শনিবার সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেন আন্দোলনরত সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
চতুর্থ বর্ষের এক শিক্ষার্থী বিবিসি বাংলাকে বলেন, ”এত বড় একটা ঘটনার পর ছাত্রলীগ আবারো ক্যাম্পাসে রাজনীতি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি। প্রশাসনের অগোচরে কিভাবে একটি সংগঠন এতো রাতে এ ধরনের প্রোগ্রাম করে?”
শনিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারের পাদদেশে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বলেন, ”মধ্যরাতে বহিরাগত রাজনৈতিক সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের এমন দাপটসহ প্রবেশ কর্তৃপক্ষ ও ডিএসডাব্লিউর দৃষ্টির অগোচরে হওয়া অসম্ভব। ঘটনার দেড় দিন পরও ছাত্রকল্যাণ পরিচালক (ডিএসডাব্লিউ) থেকে ওই ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কিত কোনো সদুত্তর এবং জবাবদিহি সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে আসেনি।”
চলছে টানা বিক্ষোভ
এ ঘটনার পরই বুয়েটে বর্তমানে চলমান পাঁচটি ব্যাচের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সমালোচনার ঝড় ওঠে। প্রতিটি ব্যাচ আলাদাভাবে নিজেদের মধ্যে আলোচনার পর তা অন্যান্য ব্যাচের সামনে তুলে ধরে। শেষে সব ব্যাচ কিছু সম্মিলিত সিদ্ধান্ত নেয় ও দাবি তোলে।
প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা শুক্রবার বিকেল থেকে আন্দোলনে নামে। শুক্রবার বিকেলে পাঁচ দফা দাবিতে নিয়ে আন্দোলন শুরু করে। সেখান থেকে শনিবার ও রোববার তারা পরীক্ষাসহ সব একাডেমিক কার্যক্রম বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন।
শুক্রবার বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার থেকে শুরু হয়ে চলে রাত আটটা পর্যন্ত। পরে কর্মসূচি স্থগিত হয় শনিবার সকাল ৭টা পর্যন্ত।
শনিবার সকাল ৭টায় বুয়েটের শহীদ মিনারের ফটকে আবারো জড়ো হন শিক্ষার্থীরা। পরে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে তারা যান প্রশাসনিক ভবনের সামনে। সকাল ৭টা থেকে শুরু হয়ে অবস্থান চলে চলে দুপুর ১২ টা পর্যন্ত। এই কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন অনেক।
সমাবেশে লিখিত বক্তব্যে বক্তারা বলেন, বুয়েট দেশের সবচেয়ে সমাদৃত ও শীর্ষস্থানীয় একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ২০১৯ সালের ৭ অক্টোবর আবরার ফাহাদ হত্যার ঘটনার পর বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ হয়। তারপর বুয়েট বাংলাদেশের সবচেয়ে নিরাপদ ক্যাম্পাসে রূপ নেয়।
চতুর্থ বর্ষের আন্দোলনরত এক শিক্ষার্থী বিবিসি বাংলাকে বলেন, “মূলত এই ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়ে আমরা আমাদের কর্মসূচি পালন করছি। ওই দাবিগুলো পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আমরা আমাদের আন্দোলন চালিয়ে যাবো”।
এ সময় তারা মধ্যরাতে রাজনৈতিক সমাগমের মূল সংগঠকদের বুয়েট থেকে স্থায়ী বহিষ্কার এবং হলের (আসন) বাতিলসহসহ ছয় দফা দাবি জানায়।
এসব দাবির মধ্যে আরও আছে, বহিরাগত যে সব রাজনৈতিক সংগঠনে জড়িতরা ক্যাম্পাসে ঢুকেছে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া, তারা কীভাবে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেছে- তার ব্যাখ্যা দেয়া এবং আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক কোনো ব্যবস্থা না নেয়া প্রতিশ্রুতি দেয়া।
আন্দোলনরত এক বুয়েট শিক্ষার্থী বিবিসি বাংলাকে বলেন, “দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আমরা কোন ধরনের একাডেমিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করবো না। এই সবগুলো দাবি পূরণ না হলে আমরা আমাদের কর্মসূচি চালিয়ে যাবো।”
মুখোমুখি ছাত্রলীগ ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা
গত দু’দিনে বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীরা যে আন্দোলন করছেন তাতে প্রায় সবগুলো ব্যাচের শিক্ষার্থীরাই অংশ নিয়েছিলো। এই আন্দোলনের কারণে শিক্ষার্থীরা চূড়ান্ত পর্ব সহ শনি ও রবিবারের সব ধরনের পরীক্ষা স্থগিত করেছে।
২০১৯ সালের ৭ অক্টোবর ছাত্রলীগের কর্মীদের হাতে বুয়েটের ছাত্র আববার ফাহাদ নিহত হওয়ার পর চার বছরেরও বেশি সময় পার হয়েছে। ঐ সময় উত্তাল আন্দোলনের প্রেক্ষিতে বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে বাধ্য হয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
এরপর কেটে গেছে প্রায় সাড়ে ৪ বছর। হত্যাকাণ্ডের দুই বছর পর ২০২১ সালের ৮ই ডিসেম্বর আবরার ফাহাদকে হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন ২০ জন ও যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পেয়েছেন পাঁচ জন।
গত শুক্রবার থেকে সাধারণ শিক্ষার্থীরা যে আন্দোলন করছে সেখানে অনেক প্ল্যাকার্ডে আবরারকে স্মরণ করতে দেখা গেছে। সেখানে কারো হাতে ছিলো আবরারের ছবি, তাদের কারো প্লাকার্ডে লেখা ছিলো- ‘আবরার ভাইয়ের রক্ত, বৃথা যেতে দেবো না’।
কারো কারো প্লাকার্ডে লেখা ছিলো, ‘নো স্টুডেন্ট পলিটিক্স ইন বুয়েট’। শিক্ষার্থীদের অনেকেই আবার ‘রক্তের দাগ শুকায় নাই’সহ নানা ধরনের প্রতিবাদী শ্লোগানে প্রতিবাদ করতে দেখা গেছে।
ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান বিবিসি বাংলাকে বলেন, “বুয়েটে দুইটি ধারা স্পষ্ট আমরা দেখছি। তার একটি হচ্ছে মৌলবাদী ধারা আরেকটি হচ্ছে স্বাধীনতার স্বপক্ষ শক্তি। মৌলবাদী ধারাটি বিষয়টিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা করছে।”
তিনি বলেন, ”আমরা চাই বুয়েটে সুস্থ্য সুন্দর একটি সার্বিক শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত হোক। ক্যাম্পাস মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তির প্রতিচ্ছবি হয়ে প্রস্ফুটিত হোক।”
সাধারণ শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কল্যাণ পরিচালকের পদত্যাগ দাবি করা হলেও বুয়েট উপাচার্য অধ্যাপক সত্য প্রসাদ মজুমদার বলছেন, এই ঘটনায় কোন ভাবেই দায়ী নন, ছাত্রকল্যাণ পরিচালক। তাই তাকে অব্যহতি দেয়া হবে না বলেও জানান তিনি।
মূল অভিযুক্তের সিট বাতিল
মধ্যরাতে বুয়েটে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের প্রবেশের ঘটনায় মূল অভিযুক্ত শিক্ষার্থীর হলের সিট বাতিল করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
শুক্রবার রাতে বুয়েটের রেজিস্টার অধ্যাপক ড. মো. ফোরকান উদ্দিন স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
তার সিট বাতিলের কথা উল্লেখ করে বিজ্ঞপ্তিতে আরও উল্লেখ করা হয়, এছাড়া সার্বিক বিষয়ে তদন্ত পূর্বক সুপারিশ প্রদান করার জন্য একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। তদন্ত কমিটির রিপোর্ট পাওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর টার্ম বা সেমিস্টার ফাইনালসহ সব অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম চলমান থাকবে বলেও বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।
শনিবার দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সত্য প্রসাদ মজুমদার বলেন, ”মূল অভিযুক্ত ইমতিয়াজ হোসেনকে হল থেকে বহিষ্কার করা আমার এখতিয়ারে আছে। টার্ম থেকে বহিষ্কার করতে একাডেমিক কাউন্সিল ও ডিসিপ্লিনারি কমিটির মাধ্যমে হতে হবে”।
এই ঘটনা তদন্তে ছয় সদস্যের একটি কমিটি গঠন করার কথা জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এই কমিটিকে আগামী ৮ই এপ্রিলের মধ্যে রিপোর্ট জমা দিতে বলা হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সংবাদ সম্মেলনে জানান, তদন্ত কমিটির রিপোর্ট ও সব প্রক্রিয়া না মেনে কোন ধরনের ব্যবস্থা নিলে সেটি কোর্টে টিকবে না। তাই তারা যথাযথ প্রক্রিয়া মেনেই পদক্ষেপ নেবেন।