হোম ইসলাম রমজানে আমাদের কেমন খাবার খাওয়া উচিত

রমজানে আমাদের কেমন খাবার খাওয়া উচিত

0
রমজানে আমাদের খাবার

সময়ের আবর্তে আবারও এসে গেল ইসলামিক ক্যালেন্ডারের পবিত্রতম মাস রমজান। বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মুসলিম প্রতি বছরের মতো এবারও রমজান পালন করছেন।

ইসলামের পবিত্র গ্রন্থ কোরান নাজিল হয়েছিল এই রমজান মাসেই। এসময় মুসলিমদের জন্য মাসব্যাপী রোজা রাখা বাধ্যতামূলক এবং এটি ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের একটি।

সাধারণত সুস্বাস্থ্যের অধিকারী মানুষদের রোজা রাখতে হয়। অসুস্থ, বয়ঃসন্ধি পার না হওয়া শিশু, গর্ভবতী, স্তন্যদায়ী মা বা ঋতুস্রাব চলমান নারী এবং যারা সফররত ব্যক্তিদের জন্য রোজার অব্যাহতি থাকে।

যেহেতু রোজা থাকা অবস্থায় কোনও পানাহার করা যায় না তাই এ মাস জুড়েই প্রাধান্য পায় রোজা শুরুর আগে সেহরি বা সুহর এবং সমাপ্তির জন্য ইফতার।

কোন ধরনের খাবার ক্ষুধা ও তৃষ্ণা নিবারণে এবং মাসজুড়ে সচল থাকতে সাহায্য করতে পারে?

সেহরিতে কোন ধরনের খাবার?

সেহরিতে পুষ্টিকর খাবার গুরুত্বপূর্ণ
ছবির উৎস,GETTY IMAGES

রোজা রাখার প্রস্তুতি সেহরি দিয়েই শুরু হয়। এজন্য সঠিক ধরনের খাবার খাওয়া গুরুত্বপূর্ণ যা সারাদিনের ক্ষুধা মোকাবেলায় সাহায্য করবে।

“রমজান মাসে দিনভর যে শক্তি ও পুষ্টির চাহিদা থাকে তা পূরণে সেহরি ও ইফতারে এমন খাবার খেতে হবে যেগুলো প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, ভিটামিন ও মিনারেল সমৃদ্ধ এবং এ সময় যথেষ্ট পানি পান করতে হবে,” বলছিলেন তুরস্কের পুষ্টিবিদ ইসমেত তামের।

তিনি মূলত পুষ্টিকর কিন্তু খুব বেশি ভারী না, আবার পেট ভরবে এমন খাবারে গুরুত্ব দেন।

যেমন দুগ্ধজাত খাবার, ডিম, শসা-টমেটোর মতো সালাদ, ফলমূল, স্যুপ, অলিভ অয়েল অথবা কম তেলে রান্না করা সবজি এমন খাবারের দিকে গুরুত্ব দেন তিনি।

এছাড়া মাছ, মাংস এবং সবজির পাশাপাশি ‘দই-চিড়া’র মতো খাবারের দিকেও গুরুত্ব দেন অনেক পুষ্টিবিদ।

দেহের পানির চাহিদা পূরণে ইফতারের সময় থেকে সেহরি পর্যন্ত অন্তত দুই থেকে তিন লিটার পানি খাওয়ার পরামর্শ কমবেশি সবাই দেন।

ছবির উৎস,GETTY IMAGES

আরেক পুষ্টিবিদ ব্রিজেট বেনেলামের মতে সেহরিতে জটিল ধরনের শর্করা খাবার খাওয়া ভালো, বিশেষত হোলগ্রেইন বা পূর্ণাঙ্গ শস্য, কারণ তেমন খাবার ধীরে ধীরে শরীরে শক্তি সঞ্চার করে যেটা সারাদিনের জন্য উপকারি।

“ওটস, হোলগ্রেইন বা সম্পূর্ণ শস্যের রুটি, সিরিয়াল এ জাতীয় খাবার সেহরির জন্য বেশ ভালো” উদাহরণ দেন তিনি।

এক্ষেত্রে আরেকটি বিবেচনার বিষয় হলো যেসব খাবারে ফাইবার বা আঁশ বেশি থাকে। কিছু গবেষণায় দেখা যায় মটরশুঁটি, শিম বা ছোলার মতো খাবার ভরপেট খাবার খাওয়ার মতো অনুভূতি ৩০ শতাংশের বেশি বাড়িয়ে দেয়।

আঁশযুক্ত খাবারের মধ্যে আরও রয়েছে ডাল জাতীয় শস্য, খোসাসহ রান্না করা আলু বা শেকড় জাতীয় সবজি, বাদাম, তেলবীজ জাতীয় খাদ্য এবং ফলমূল। হোলগ্রেইন আটার রুটি ছাড়াও বাদামি চালেও আঁশ থাকে।

তবে পর্যাপ্ত পানি করার পাশাপাশি লবণাক্ত খাবারের বিষয়ে বিশেষভাবে সতর্ক করেন পুষ্টিবিদ বেনেলাম।

“লবনযুক্ত খাবার পানির তৃষ্ণা বাড়িয়ে দেয় এবং যেখানে সারাদিন পানি পান করা যাবে না সে অবস্থায় তৃষ্ণার্ত হওয়ার মতো পরিস্থিতি নিশ্চয়ই কেউ চাইবেন না,” বলেন তিনি।

সেহরিতে ক্যাফেইন আছে তেমন পানীয় পরিহার করাও গুরুত্বপূর্ণ।

ইফতারে কী খাবার?

ছবির উৎস,GETTY IMAGES

রোজা ভাঙ্গার ক্ষেত্রেও যথেষ্ট পরিমাণে তরল পদার্থের পাশাপাশি শরীরে শক্তি পেতে এমন খাবারও গুরুত্বপূর্ণ যেখানে প্রাকৃতিক চিনি রয়েছে। এ চাহিদা মেটাতে ইসলামের নবী মোহাম্মদের সময় থেকে খেজুরই সবচেয়ে বেশি খেয়ে আসছে মানুষ।

“শক্তি সঞ্চয় এবং দেহে পানির ঘাটতি পূরণে খেজুর এবং পানি রোজা ভাঙ্গার খুবই উৎকৃষ্ট উপায়,” বলেন পুষ্টিবিদ ব্রিজেট বেনেলাম।

এছাড়া ডাল, শিম বা মটরশুঁটির মতো বীজ, সবজি দিয়ে তৈরি করা স্যুপও উৎকৃষ্ট হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি, কারণ এতে করে দেহে পর্যাপ্ত “পুষ্টি ও আঁশ পাওয়া যায় কোনও হাঁসফাঁস বোধ করা ছাড়াই।”

“সারাদিন না খেয়ে থাকার পর খুব ভারী খাবার দিয়ে শুরু করলে তা হয়তো আপনাকে ক্লান্ত, অলস ও অসুস্থ বোধ করাতে পারে,” বলছিলেন তিনি।

দেশ ও সংস্কৃতি ভেদে ইফতারের খাবারের ধরনও ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে।

যেমন বাংলাদেশে ভাজাপোড়া খাবার বেশ প্রচলিত যা সাধারণত খুব একটা স্বাস্থ্যকর হয় না, বিশেষত তেলটা যদি ভালো না হয়। স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে ভাজাপোড়া খাবার বাদ দিয়ে দেবেন এমন মানুষ হয়তো খুঁজে পাওয়া কঠিন।

তাই তেমন খাবার পুরোপুরি বাদ না দিলেও পরিমিতি বজায় রেখে খাওয়ার কথা বলেন অনেক বিশেষজ্ঞ।

ছবির উৎস,GETTY IMAGES ছবির ক্যাপশান, রমজান মাসে অনেক সময়েই বেশি খাওয়া হয়ে যায়

তবে ইফতারের খাবার ভারসাম্যপূর্ণ হওয়াটা প্রয়োজন। যেমন স্টার্চসমৃদ্ধ বা শর্করাজাতীয় খাবার, আঁশসমৃদ্ধ সবজি-ফলমূল, দুগ্ধজাত খাবার, প্রোটিনসমৃদ্ধ মাছ-মাংস বা ডিমের মতো বিভিন্ন ধরনের খাবার ভারসাম্য রেখে খাওয়া উচিৎ।

মিষ্টি বা মাত্রাতিরিক্ত মিষ্টিজাতীয় খাবার পরিহার করা উচিৎ কারণ এতে করে ওজন বেড়ে যেতে পারে।

কিছু পুষ্টিবিদ একবারে বেশি খাওয়ার পরিবর্তে ইফতারের খাবারকে দুটি ভাগে ভাগ করার পরামর্শ দেন, কারণ তা রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি বদহজমের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করবে।

যুক্তরাজ্যের পুষ্টিবিদ এবং ডায়েটিশিয়ান নাজিমা কুরেশির মতে ইফতারিতে সপ্তাহে একদিন বেশি খাওয়া হয়ে গেলে তেমন সমস্যা নেই, কিন্তু সেটা যেন প্রতিদিন না হয়।

তার মতে, “অতিরিক্ত খাওয়ার ফলে আপনি অনুভব করবেন যে আপনি স্বাভাবিকের চেয়ে দুর্বল বোধ করছেন এবং পরেরদিনের রোজার জন্য উৎসাহ পাচ্ছেন না।”

সেক্ষেত্রে তার পরামর্শ পানি দিয়ে ইফতার শুরু করে খেজুর ও কিছু ফল খেয়ে প্রার্থনা শেষ করে নেয়া। এরপর বাকি খাওয়াদাওয়া করা। যে কোনও খাবারই হোক না কেন, সেখানে যেন প্রোটিন, শর্করা জাতীয় খাবার ও সবজি থাকে তা নিশ্চিত করতে হবে।

রোজা রাখা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো?

রোজা রাখার স্বাস্থ্য উপকারিতা রয়েছে যে কারণে ইদানিং ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং ওজন কমানোর জন্য জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং কী খাবেন তার পরিবর্তে কখন খাবেন সেদিকে নজর দেয় যার মধ্যে প্রতিদিন একটা সময় ধরে না খেয়ে থাকতে হয়।

এ পদ্ধতিতে শরীরের জমা থাকা চিনি সব ব্যবহার করে ফেলা হয়, এরপর চর্বি গলতে শুরু করে যাতে করে ওজন কমে।

গবেষণায় দেখা গেছে এটি রক্তচাপ ও কোলেস্টেরল কমানো, প্রদাহের প্রবণতা কমানো, টাইপ-টু ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমানো এবং ইনসুলিনের কাজকে উন্নত করতে সাহায্য করে।

সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় দেখা গেছে রমজান মাসে রোজা রাখলে তা ফুসফুস, কোলোরেক্টাল ও স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে কমায়।

রমজান মাসে রোজা রাখা এবং ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং দুটো একইরকম বিষয়, ফলে এর সুফলও এক ধরনের।

আমেরিকান জার্নাল অফ ক্লিনিক্যাল নিউট্রিশন-এ প্রকাশিত একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে রমজান মাসে রোজা রাখা হজমের প্রক্রিয়ায় ইতিবাচক প্রভাব রাখতে এবং দীর্ঘস্থায়ী রোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।

ক্যামব্রিজের এডেনব্রুকস হাসপাতালের অ্যানেসথেসিয়া এন্ড ইনটেনসিভ কেয়ার মেডিসিনের কনসালট্যান্ট ড. রাজিন মাহরুফের মতে, “রোজা রাখা শরীরের জন্য ভালো, কারণ এটি আমরা কী খাই এবং কখন খাই সেটার ওপর আমাদের মনোযোগ দিতে সাহায্য করে।”

তবে রমজান মাসের বাইরে একটানা রোজা রাখাটা নিরুৎসাহিত করছেন তিনি। কারণ একটা সময় আপনার শরীর চর্বি গলিয়ে তা শক্তিতে পরিণত করার কাজ বন্ধ করে দেবে। তখন এটি শক্তির জন্য নির্ভর করবে মাংসপেশির ওপর। এটা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নয়। কারণ আপনার শরীর তখন ক্ষুধায় ভুগবে, বলছিলেন তিনি।

আবার পুষ্টিবিদ ব্রিজেট বেনেলামের মতে রমজানের সময় সাধারণত এক কেজির মতো ওজন কমতে পারে, কিন্তু ইফতারে বেশি খাওয়া দাওয়া হলে ওজন উল্টো বেড়েও যেতে পারে।

ইফতারের টেবিলে হরেক রকম খাবার থাকলে বেশি খাওয়ার প্রবণতাও তৈরি হতেই পারে। তবে তার মতে “সামনে যা থাকবে সবই খাওয়ার প্রয়োজন নেই, তাই বেছে বেছে খাবার নিন এবং ধীরে ধীরে খান।”

সেহরি বা ইফতার, যে কোনও ক্ষেত্রেই অন্তত তেমন খাবার নিশ্চিত করতে হবে যেন শরীর পর্যাপ্ত পুষ্টি পায়।

মতামত নাই

একটা কিছু লিখে জান

আপনার মতামত টি লিখুন!
এখানে আপনার নাম লিখুন

error: Content is protected !!

Discover more from গ্রাম বাংলা

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Exit mobile version