হোম বাংলাদেশ ঢাকা ৭ই মার্চ ১৯৭১ কি করতে চাচ্ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী

৭ই মার্চ ১৯৭১ কি করতে চাচ্ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী

0
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে ভাষণ দেবার সময় শেখ মুজিবুর রহমান

১৯৭১ সালের পহেলা মার্চ ঢাকা স্টেডিয়ামে একটি ক্রিকেট ম্যাচ চলছিল পাকিস্তান বনাম আন্তর্জাতিক একাদশের মধ্যে। তখন পাকিস্তান একাদশের পক্ষে একমাত্র বাঙালি ক্রিকেটার ছিলেন রকিবুল হাসান, যিনি পরবর্তীতে বাংলাদেশ জাতীয় দলের অধিনায়ক হয়েছিলেন।

তার ভাষ্যমতে, স্টেডিয়ামে তখন ৪০ হাজারের মতো দর্শক ছিল। তাদের অনেকই রেডিও নিয়েছিলেন সাথে। এর একটি বড় কারণ ছিল পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি তখন উত্তাল। রেডিওর খবরের দিকে অনেকের মনোযোগ।

খেলার মাঠে বসেই অনেকে শুনতে পান যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করেছেন। সাথে সাথে বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে পুরো স্টেডিয়াম।

“জয় বাংলা শ্লোগানে পুরো স্টেডিয়াম মুখরিত হয়ে ওঠে। খেলা বন্ধ হয়ে যায়। বিক্ষুব্ধ দর্শকরা তখন স্টেডিয়াম ছেড়ে রাস্তায় নেমে আসে,” বিবিসি বাংলার কাছে সেদিনের পরিস্থিতির বর্ণনা করছিলেন রকিবুল হাসান।

১৯৭১ সালের পহেলা মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান রেডিওতে ভাষণের মাধ্যমে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করেন। সাথে সাথে মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। অফিস-আদালত, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে অনেকে বিক্ষোভ দেখানোর জন্য রাস্তায় নেমে আসে।

সেদিন শেখ মুজিবুর হোটেল পূর্বানীতে আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারি পার্টির বৈঠক করছিলেন।

রেডিওতে ঘোষণা শোনার কিছুক্ষণের মধ্যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ও নানা জায়গা থেকে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আসলো। হোটেল পূর্বানীর চারপাশ তখন লোকে-লোকারণ্য। কারণ, অনেকই জানতো শেখ মুজিবুর রহমান সেখানে বৈঠক করছেন।

মার্চ মাসের দুই তারিখে ঢাকায় এবং তিন তারিখে সারাদেশে হরতালের ডাক দেয়া হলো। এছাড়া মার্চ মাসের চার তারিখ থেকে ছয় তারিখ পর্যন্ত দেশজুড়ে স্বতঃ:স্ফূর্ত হরতাল পালিত হয়। মার্চ মাসের চার তারিখ থেকে ছয় তারিখ পর্যন্ত ঢাকায় প্রতিদিন সকাল ছয়টা থেকে দুপুর দুইটা পর্যন্ত হরতাল চলতে থাকে।

এমন অবস্থায় দোসরা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন তৎকালীন ছাত্র নেতারা।

পরিস্থিতি তখন আর পাকিস্তান সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই। শেখ মুজিব হয়ে উঠেছিলেন সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী। তিনি যা বলছিলেন, সেটাই ছিল শিরোধার্য।

২০১৬ সালে বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা তোফায়েল আহমেদ বলছিলেন, আন্দোলন এবং মানুষের আকাঙ্ক্ষা বিবেচনায় নিয়েই শেখ মুজিব ৩রা মার্চ পল্টনে ছাত্র সমাবেশে ৭ই মার্চ ভাষণ দেয়ার ঘোষণা করেছিলেন।

অন্যদিকে মার্চ মাসের তিন ও চার তারিখ রাত আটটা থেকে কারফিউ জারি করে সরকার। তখন কারফিউ অগ্রাহ্য করে মানুষ বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ মিছিল শুরু করে।

শেখ মুজিব
ছবির উৎস,সিআরআই ছবির ক্যাপশান, ১৯৬৯ সালের গণ আন্দোলনের মাধ্যমে কারাগার থেকে বেরিয়ে আসার পর শেখ মুজিব অনেক প্রভাবশালী ওঠেন।

ভাষণ নিয়ে নানা জল্পনা

তখন ঢাকা শহরের পরিস্থিতি খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন জাহানারা ইমাম, যিনি ১৯৯০’র দশকে ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি গঠনের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলেন।

১৯৭১ সালের নানা বর্ণনা জাহানারা ইমাম-এর ‘একাত্তরের দিনগুলি’ বইতে পাওয়া যায়। শুধু ঢাকা শহর নয়, দেশজুড়ে নানা গুঞ্জন তখন চলছিলেন।

জাহানারা ইমাম লিখেছেন, সাতই মার্চ রেসকোর্সে গণজমায়েতে শেখ কী বলবেন, তা নিয়েও লোকজনের জল্পনা-কল্পনার অবধি নেই। এক তারিখে হোটেল পূর্বানীতে তিনি বলেছিলেন, বাংলার মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার অর্জনের কর্মসূচীর ঘোষণা তিনি সাত তারিখে দেবেন।

ইতোমধ্যে অনেক ঘটনা ঘটেছে। মিটিং, মিছিল ও কারফিউর তীব্রতা বেড়েছে। পুলিশের গুলিতে বহু মানুষ নিহত হয়েছেন।

“এর প্রেক্ষিতে শেখ আগামীকাল কী ঘোষণা দেবেন? কেউ বলছেন, উনি আগামীকাল স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন। কেউ বলছে, তা কী করে হবে? উনি নির্বাচনে জিতে গণপ্রতিনিধি, মেজরিটি পার্টির লিডার, উনি দাবির জোরে সরকার গঠন করবেন, স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করবেন। এখন স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে সেটা তো রাষ্ট্রদ্রোহিতার পর্যায়ে পড়বে,” লিখেছেন জাহানারা ইমাম।

ছবির উৎস,GETTY IMAGES ছবির ক্যাপশান, যুদ্ধপরাধীদের বিচারের দাবিতে ১৯৯০’র দশকে রাস্তায় নেমে আসেন জাহানারা ইমাম।

মুজিবের ওপর চাপ

সাতই মার্চের আগে ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবের বাসভবনে আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হয়। সে বৈঠকের আলোচ্য বিষয় ছিল, রেসকোর্স ময়দানের ভাষণে শেখ মুজিব কোন পথ অনুসরণ করবেন।

গুরুত্বপূর্ণ সে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা ড. কামাল হোসেন। তাকে উদ্ধৃত করে অধ্যাপক রেহমান সোবহান তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, সম্ভবত বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীনের নেতৃত্বে সিনিয়র নেতাদের বক্তব্য ছিল স্বাধীনতা ঘোষণার সময় এখনো আসেনি। মানুষকে এমন রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ে নিয়ে আসার আগে জনসচেতনতা আরো সংহত করা প্রয়োজন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে অধ্যাপক রেহমান সোবহানের নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।

অধ্যাপক সোবহানের ভাষ্য মতে, বর্ষীয়ান নেতাদের বিপরীতে সিরাজুল আলম খানের মতো আওয়ামী লীগের তরুণ প্রজন্ম অনতিবিলম্বে স্বাধীনতা ঘোষণার সপক্ষে কথা বলেছিল।

সাতই মার্চ জনসভায় যাবার আগে অধ্যাপক রেহমান সোবহান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ইকবাল হলে গিয়েছিলেন তরুণ নেতাদের মনোভাব বুঝতে। সেখানে সিরাজুল আলম খানের সাথে তার দেখা হয়েছিল বলে উল্লেখ করেন অধ্যাপক রেহমান সোবহান।

“তাকে বিষণ্ণ দেখাচ্ছিল এবং সে আমাদের বলে যে স্বাধীনতার কোন নাটকীয় ঘোষণা আশা করা যাবে না। দেখা গেল বঙ্গবন্ধু তার রাজনৈতিক জীবনের সেরা কর্তৃত্বব্যঞ্জক ভাষণ দিয়েছেন। যেখানে স্বাধীনতা ঘোষণা না করেও তিনি স্পষ্ট বুঝিয়ে দেন স্বাধীনতার লড়াইয়ে নিজেকে সমর্পণের জন্য প্রস্তুত হতে হবে বাঙালিকে,” লিখেছেন অধ্যাপক অধ্যাপক সোবহান।

ছবির উৎস,CPD ছবির ক্যাপশান, অধ্যাপক রেহমান সোবহান

সামরিক সরকারের প্রস্তুতি

সাতই মার্চ শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণকে ঘিরে পাকিস্তান সরকারের মধ্যেও নানা চিন্তা ও উদ্বেগ কাজ করছিল। তাদের ধারণা ছিল, সেদিন শেখ মুজিবুর রহমান হয়তো স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে বসতে পারেন।

শেখ মুজিব যাতে সে রকম কিছু না করেন, সেজন্য পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও সেনাবাহিনীর দিক থেকে নানা প্রচেষ্টা ছিল।

তখন পূর্ব পাকিস্তানে কর্মরত ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা সিদ্দিক সালিক। মি. সালিক তার ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ বইতে সে সময়কার বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরেছেন।

সিদ্দিক সালিকের বর্ণনা মতে ৭ই মার্চ যতই এগিয়ে আসতে থাকে, গুজব, ভয়, আতঙ্ক ও উদ্বেগ ততই জোরালো হতে থাকে।

“এটা ধারণা করা হচ্ছিল যে শেখ মুজিবুর রহমান একতরফাভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের ঘোষণা দেবেন,” লিখেছেন মি. সালিক।

শেখ মুজিবুর রহমান ভাষণ দেবার আগের দিন অর্থাৎ ৬ই মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছিলেন। সে ভাষণ দেবার আগে মি. খান শেখ মুজিবুর রহমানকে টেলিফোন করেছিলেন।

তখন ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর সড়কে অবস্থিত শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে ছিলেন তার জামাতা ও শেখ হাসিনার (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী) স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়া।

সে সময়কার বিভিন্ন ঘটনা ড. মিয়া তার ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু স্মৃতি, কিছু কথা’ বইতে তুলে ধরেছেন।

ওয়াজেদ মিয়া লিখেছেন, শেখ মুজিবুর রহমান টেলিফোনে ইয়াহিয়া খানকে বলেন যে আন্দোলন চলার সময় যারা পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন, সেটির জন্য আন্তরিক দুঃখ এবং নিহতদের পরিবারের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করে ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করার জন্য একটি উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়।

শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের টেলিফোন আলাপের বিষয়টি দেখা যায় সিদ্দিক সালিকের ভাষ্যেও।

সেখানে মি. সালিক লিখেছেন, শেখ মুজিবের সাথে টেলিফোনে আলাপের পর ইয়াহিয়া খান একটি টেলিপ্রিন্টার মেসেজ পাঠিয়েছিলেন শেখ মুজিবের জন্য।

সিদ্দিক সালিকের ভাষ্য মতে, সেই মেসেজে ইয়াহিয়া খান লিখেছিলেন, দয়া করে তাড়াহুড়া করে কোন সিদ্ধান্ত নেবেন না। আমি শীঘ্রই ঢাকা আসবো এবং আপনার সাথে বিস্তারিত আলাপ করবো। আমি আপনাকে এই নিশ্চয়তা দিতে পারি যে জনগণের প্রতি আপনার যে প্রতিশ্রুতি এবং আকাঙ্ক্ষা সেটির প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা দেখানো হবে।

ছবির উৎস,GETTY IMAGES ছবির ক্যাপশান, ইয়াহিয়া খান

এই বার্তাটি সেনাবাহিনীর একজন ব্রিগেডিয়ার ব্যক্তিগতভাবে ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবের বাড়িতে গিয়ে তার কাছে হস্তান্তর করেছিলেন বলে সিদ্দিক সালিক উল্লেখ উল্লেখ করেন।

তিনি আরও লিখেছেন, ৭ই মার্চ সকালে পাকিস্তানে নিযুক্ত আমেরিকার রাষ্ট্রদূত জোসেফ সিম্পসন ফারল্যান্ড শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে দেখা করেন।

মার্চ মাসের শুরু থেকে পাকিস্তান সরকার পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্যদের এনে ঢাকায় জড়ো করতে থাকে।

সাতই মার্চের জনসভায় শেখ মুজিব যদি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন তাহলে এর পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে বলে পাকিস্তানের সামরিক কর্মকর্তারা বলেছিলেন। ১৯৭১ সালে ঢাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১৪তম ডিভিশনের জিওসি ছিলেন মেজর জেনারেল খাদিম হুসেইন রাজা।

‘অ্যা স্ট্রেঞ্জার ইন মাই ওউন কান্ট্রি’ বইতে মি. রাজা তার বইতে এর বিবরণ দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ৬ই মার্চ আওয়ামী লীগের দুই ব্যক্তি তার সাথে দেখা করতে এসেছিল।

ছবির ক্যাপশান, ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে ১৪তম ডিভিশনের জিওসি ছিলেন মেজর জেনারেল খাদিম হুসেইন রাজা।

জেনারেল রাজা দাবি করেন, সেই ব্যক্তিদের তিনি বলেছিলেন, ক্যান্টনমেন্টে সৈন্যরা অস্ত্র ও ট্যাঙ্ক নিয়ে তৈরি আছে। রেসকোর্স ময়দান থেকে তিনি সরাসরি শেখ মুজিবের ভাষণ শোনার ব্যবস্থাও রেখেছেন। শেখ মুজিব যদি পাকিস্তানের অখণ্ডতাকে আক্রমণ করে এবং একতরফাভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয় তাহলে সৈন্যরা সাথে সাথে জনসভার দিকে অগ্রসর হবে এবং সেখানে হামলা চালাবে।

“প্রয়োজনে ঢাকা মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হবে,” এমন কথা জেনারেল রাজা উল্লেখ করেছেন তার বইতে।

৭ই মার্চ পরিস্থিতি

সাতই মার্চ সকালে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি ছিল লোকে-লোকারণ্য । এ অবস্থা এর আগে থেকেই অবশ্য চলমান ছিল। আওয়ামী লীগ নেতা ও বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীরা সকাল থেকেই সেখানে জমায়েত হতে থাকেন। জনসভার বিষয় নিয়ে তিনি নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনা করেন।

এরপর তিনি সিনিয়র আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে একটি বৈঠক করেন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন – সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এ.এই.এম. কামরুজ্জামান, মনসুর আলী, তাজউদ্দিন আহমদ, খন্দকার মোশতাক আহমদ ও ড. কামাল হোসেন।

বৈঠক শেষে শেখ মুজিবুর রহমান উপস্থিত আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য সংগঠনের নেতা-কর্মীদের বলেন যে, তারা বৈঠকে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন – রেসকোর্সের জনসভায় চার দফা ঘোষণা দেয়া হবে। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও ছাত্র-জনতার দাবির প্রতি সংহতি রেখে এ ঘোষণা দেয়া হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

এরপর এই চার-দফার একটি খসড়া প্রস্তুত করে ড. কামাল হোসেন শেখ মুজিবুর রহমানের অনুমোদন নেন। তার অনুমোদনের পর সেটি টাইপ করা হয়।

ড. ওয়াজেদ মিয়া লিখেছেন, টাইপ করা কপির সাথে হাতে লেখা খসড়া কপি মিলিয়ে দেখার দায়িত্ব শেখ মুজিব তাকে দিয়েছিলেন।

“এক পর্যায়ে খন্দকার মোশতাক কাকাকে জিজ্ঞেস করলাম যে, ইশতেহারে স্বাধীনতা ঘোষণার কথা উল্লেখ করা হয়েছে কিনা।”

“তিনি (খন্দকার মোশতাক) বলেন যে, সামরিক শাসনের ক্ষমতাবলে জারীকৃত আইনগত কাঠামো-এর অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়ে ঢাকায় বসে পাকিস্তানের অখণ্ডতা লঙ্ঘন সংক্রান্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করার ব্যাপারটি খুব ঝুঁকিপূর্ণ। সুতরাং এই ব্যাপারটা এই ইশতেহারে লেখা হয়নি,” লিখেছেন ড. ওয়াজেদ মিয়া।

সেদিন রেসকোর্স ময়দানে নৌকা আকৃতির মতো করে জনসভার মঞ্চ করা হয়েছিল। সকাল থেকেই লাখো মানুষ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের দিকে যেতে থাকে। পুরো রেসকোর্স ময়দান ও তার আশপাশের এলাকা একবারে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। বিকেল চারটার পর শেখ মুজিবুর রহমান সভাস্থলে আসেন। সে ভাষণে শেখ মুজিবুর রহমান অহিংস এবং অসহযোগ আন্দোলন আরও জোরদার করার আহবান জানান।

একই সাথে তিনি পাকিস্তান সরকারের প্রতি চারটি দাবি তুলে ধরেন।

১. অবিলম্বে মার্শাল ল প্রত্যাহার করতে হবে

২. জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে

৩. সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে

৪. সেনাবাহিনীর গুলি বর্ষণ ও মানুষ হত্যার ঘটনা তদন্ত করতে হবে

ছবির ক্যাপশান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ
ছবির ক্যাপশান, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামরুজ্জামান

তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, “সামরিক শাসন তুলে নেয়া এবং সৈন্যদের ব্যারাকে ফেরত নেয়াসহ পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতি চারটি শর্তের ব্যাপারেই শুধু বঙ্গবন্ধু তাঁর সহকর্মীদের সাথে আলোচনা করেছিলেন।”

“ভাষণ দিতে বাসা থেকে বেরোনোর সময় শেখ মুজিবকে তাঁর স্ত্রী শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব বলেছিলেন – তুমি যা বিশ্বাস করো, তাই বলবে। ৭ই মার্চের সেই ভাষণ তিনি নিজের চিন্তা থেকেই দিয়েছিলেন। ভাষণটি লিখিত ছিলো না।”

রেসকোর্সে ৭ই মার্চের বহু প্রত্যাশিত জনসভায় বঙ্গবন্ধু তার ঐতিহাসিক ঘোষণা করলেন – “এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”

সে বিশাল সমাবেশ এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মনোভাব দেখে বেশ চিন্তায় পড়ে যায় পাকিস্তান সরকার। একই সাথে তারা বুঝতে পারে শেখ মুজিবের কর্তৃত্ব চ্যালেঞ্চ রীতিমতো অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নানা শ্রেণি পেশার মানুষ সে ভাষণ শোনার জন্য রেসকোর্স ময়দানে এসেছিলেন।

জাহানারা ইমামের বর্ণনায় – কত দূর-দূরান্তর থেকে যে লোক এসেছিল মিছিল করে, লাঠি আর রড ঘাড়ে করে – তার আর লেখাজোখা নেই। টঙ্গী, জয়দেবপুর ডেমরা – এসব জায়গা থেকে তো বটেই, চব্বিশ ঘণ্টার পায়ে হাঁটা পথ পেরিয়ে ঘোড়াশাল থেকেও বিরাট মিছিল এসেছিল গামছায় চিড়ে-গুড় বেঁধে। অন্ধ ছেলেদের মিছিল করে মিটিংয়ে যাওয়ার কথা শুনে হতবাক হয়ে গেলাম। বহু মহিলা, ছাত্রী মিছিল করে মাঠে গিয়েছিল শেখের বক্তৃতা শুনতে।

সাতই মার্চ ভাষণের পর শেখ মুজিবুর রহমান আশঙ্কা করছিলেন যে তার ওপর যে কোন সময় পাকিস্তানী বাহিনীর পদক্ষেপ আসতে আসতে পারে। এ বিষয়টি তিনি পারিবারিক মহলেও বলেছিলেন।

“ ৭ই মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ হাসিনা, শেখ কামাল, শেখ জামাল, রেহানা, রাসেল, শেখ শহীদ, শাশুড়ি ও আমাকে নিয়ে খাওয়ার সময় গম্ভীর হয়ে বললেন, আমার যা বলার ছিল তা আজকের জনসভায় প্রকাশ্যে বলে ফেলেছি। সরকার এখন আমাকে যে কোন মুহূর্তে গ্রেফতার বা হত্যা করতে পারে। সেজন্য আজ থেকে তোমরা প্রতিদিন দু’বেলা আমার সঙ্গে একত্রে খাবে,” লিখেছেন ওয়াজেদ মিয়া।

সিদ্দিক সালিকের বর্ণনায় – রেসকোর্স ময়দানে মানুষের যে জোয়ার এসেছিল সেটি জনসভা শেষে ভাটার মতো মিলিয়ে গেল। মানুষজনকে দেখে মনে হচ্ছিল, তারা যেন কোন মসজিদ বা চার্চের ধর্মীয় জমায়েত থেকে ফিরছে, যেখানে তারা সন্তুষ্টির বাণী শুনেছে।

শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চ ভাষণের পর তাঁর নির্দেশে শুরু হয় পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলন। এরপর থেকে শেখ মুজিবুর রহামনের নির্দেশে চলতে থাকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান।

৭ই মার্চ সরকারের এক তথ্য বিররণীতে বলা হয়, সপ্তাহ-জুড়ে সহিংসতায় ১৭২ জন নিহত এবং ৩৫৮জন আহত হয়। এদের মধ্যে ৭৮ জন নিহত হয় চট্টগ্রামে বিক্ষোভকারীদের নিজেদের মধ্যে সংঘাতে।

মতামত নাই

একটা কিছু লিখে জান

আপনার মতামত টি লিখুন!
এখানে আপনার নাম লিখুন

error: Content is protected !!

Discover more from গ্রাম বাংলা

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Exit mobile version