হোম বাংলাদেশ ঢাকা বাংলাদেশে বিদ্যুতের দাম এভাবে বাড়ছে কেন?

বাংলাদেশে বিদ্যুতের দাম এভাবে বাড়ছে কেন?

0
ফেব্রুয়ারি মাস থেকে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে

বাংলাদেশে নির্বাহী আদেশে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে দেয়ায় সাধারণ মানুষকে এ মাস থেকেই বর্ধিত দামে বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করতে হবে। ভোক্তা পর্যায়ে সাড়ে আট শতাংশ মূল্য বৃদ্ধিকে সরকারের বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে ‘মূল্য সমন্বয়’, তবে বিদ্যুৎ গ্রাহকদের কাছে এটি আরেকদফা দাম বৃদ্ধি।

নতুন দাম অনুযায়ী আবাসিক গ্রাহকদের মধ্যে ৫০ ইউনিট পর্যন্ত ব্যবহারকারীদের বিদ্যুতের মূল্য এখন ৪.৬৩টাকা এবং ৬শ ইউনিটের বেশি ব্যবহারকারী গ্রাহকের প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ১৪.৬১ টাকা।

বাংলাদেশে বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির প্রধান কারণ হচ্ছে, বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া। গত দশ বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ দ্বিগুনেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে।

বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, উৎপাদনের জন্য যে জ্বালানির প্রয়োজন তার বড় অংশ আমদানি করতে হচ্ছে। ফলে উৎপাদন খরচও ধারাবাহিকভাবে বেড়েছ।

পিডিবির এক হিসেব থেকে দেখা যায় ২০১২-১৩ অর্থবছরে বাংলাদেশে গড়ে এক ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ হতো ৫.৪৭ টাকা।

২০২২-২৩ অর্থবছরে সেই খরচ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১.০৪ টাকা। এর সঙ্গে সরবরাহ ব্যায় যুক্ত হলে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ হয় প্রতি ইউনিটে ১১.৩৮ টাকা।

এক দশক আগের বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিক্রির কারণে পিডিবির ইউনিট প্রতি গড়ে ভর্তুকি প্রয়োজন ছিল ০.৯৪ টাকা। গত অর্থবছরে এই ভর্তুকীর প্রয়োজন দাঁড়িয়েছে ইউনিট প্রতি ৫.৪৪ টাকা।

বাংলাদেশে গত দশ বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ দ্বিগুনের বেশি বেড়েছে
ছবির উৎস,GETTY IMAGES ছবির ক্যাপশান, বাংলাদেশে গত দশ বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ দ্বিগুনের বেশি বেড়েছে

একক ক্রেতা হিসেবে পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড বা পিডিবি দেশের সমস্ত বিদ্যুৎ ক্রয় করে এবং বিতরণ সংস্থাগুলোর কাছে বিক্রি করে।

কিন্তু বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ ও গড় বিক্রয়মূল্যের মধ্যে যে পার্থক্য তাতে বিপুল অঙ্কের টাকা ঘাটতি থেকে যায়। এই ঘাটতি পূরণে সরকার থেকে ভর্তুকি নেয়ার প্রয়োজন হয়।

বর্তমানে এই ঘাটতির পরিমাণ এতটাই বেড়েছে যেটি সরকারের তহবিল থেকে ভর্তুকি দেয়া চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন বিদ্যুৎ বিল বাড়িয়ে এবং ভর্তুকি দিয়ে সরকার এই ঘাটতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করছে।

পিডিবির তথ্য অনুযায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরে সংস্থাটির ঘাটতি হয়েছে ৩৯ হাজার ৫৩৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকি বাবদ পেয়েছে ২৯ হাজার ৫শ ১০ কোটি টাকা।

গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ধাপে ধাপে আরো বাড়িয়ে উৎপাদন মূল্যের সঙ্গে সমন্বয়ের নীতি নিয়েছে সরকার। এতে করে বিদ্যুতের গ্রাহক পর্যায়ে দাম আরো বাড়বে।

ছবির ক্যাপশান, জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. ম তামিম

বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি কমাতে সরকার দাম বাড়ানোর দিকেই বেশি মনোযোগ দিচ্ছে বলে মনে করেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. ম তামিম।

“ভর্তুকি কমানোর কিন্তু দুটো পদ্ধতি আছে। একটা হলো উৎপাদন খরচ কমানো আরেকটা হলো দাম বৃদ্ধি। সরকার এই মুহূর্তে কেবল দাম বৃদ্ধির কথাই বলছে,” বিবিসি বাংলাকে বলেন অধ্যাপক তামিম

তিনি বলছেন, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন বা বিইআরসি শুনানির মাধ্যমে যদি দাম বৃদ্ধি করা হতো তাহলে সেখানে কিছু প্রশ্নে উত্তর মিলতো।

কিন্তু এখন নির্বাহী আদেশে বিদ্যুতের দাম বাড়ছে। এজন্য বিইআরসিকে ‘দন্তবিহিন প্রতিষ্ঠান’ হিসেবে বর্ণনা করছেন অধ্যাপক তামিম।

“উৎপাদন খরচ কমানোর জন্য কী ব্যবস্থা নিচ্ছে এটা কিন্তু আমরা জানি না। আমার মানে হয় সরকার যদি একই সাথে মূল্য বৃদ্ধির সাথে সাথে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচটা কীভাবে কমাবে সেটার ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতো এবং আমাদেরকে জানাতো তাহলে মানুষের মধ্যে আরো আস্থা বাড়তো, বিশ্বাস বাড়তো,” বলেন অধ্যাপক তামিম।

উৎপাদন খরচ কেন বাড়ছে?

বাংলাদেশে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ ক্রমাগত বেড়ে যাওয়ার কারণ জ্বালানি সংকট। বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রাথমিক জ্বালানির ব্যবহারে আমদানি এখন অনেক বেড়ে গেছে।

বাংলাদেশ ১০ বছর আগে যেখানে বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রাকৃতিক গ্যাসের ব্যবহার ছিল ৯০ শতাংশের মতো সেটি এখন ৫০ শতাংশেরও কম।

ছবির ক্যাপশান, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানি খরচ হয়েছে ৬১ হাজার কোটি টাকার বেশি

গত ১০ বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির পেছনে সবচে বেশি দায়ী তেল-ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়ে যাওয়া এবং প্রাথমিক জ্বালানির আমদানি বৃদ্ধি।

২০২২-২৩ অর্থবছরে বিদ্যুৎ উৎপাদনে কেবল জ্বালানির ব্যায় হয়েছে ৬১ হাজার কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে আমদানিকৃত ডিজেল ও ফার্নেস অয়েলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য খরচই হয় ৩৫ হাজার কোটি টাকার বেশি।

এছাড়া আমদানি করা কয়লা এবং ভারতের আদানি গোষ্ঠির বিদ্যুৎ মিলিয়ে কয়লার জন্য জ্বালানি খরচ হয়েছে প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা।

জ্বালানি বিশষজ্ঞ ড. ম তামিম বলছেন, পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রথম থেকে বাংলাদেশ আমদানি নির্ভরতার দিকে ঝুঁকেছে। এই মুহূর্তে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রায় ৬০ শতাংশ জ্বালানি আমদানি করতে হচ্ছে। আর নিজস্ব উৎপাদন গ্যাস কমে আসছে দিনে দিনে।

“আমাদের প্রথম থেকে পরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা আমদানি নির্ভরতার দিকে গেছি। আমার মনে আছে, একসময় বলা হয়েছিল যে কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুৎ আসলে উৎপাদন খরচ আরো কমে আসবে। কিন্তু কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্রের উৎপাদন সময়মতো বাস্তবায়ন হয়নি,” বলেন অধ্যাপক তামিম।

ছবির ক্যাপশান, তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ হয় সবচে বেশি

তেল-ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, বিশেষত রেন্টাল কুইক রেন্টালের কারণে দাম বৃদ্ধি নিয়ে সমালোচনার কারণে বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে ২০১১-১২ সালের দিকে বলা হয়েছিল যে কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালু হলে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ কমে আসবে।

যদিও সেই পরিকল্পনা যথাসময়ে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে চুক্তি নবায়ন করে তেল-ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে এবং চালু না থাকলেও ক্যাপাসিটি চার্জ বা কেন্দ্রভাড়া দেয়ার বাধ্যবাধকতা থাকায় বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বেড়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

উৎপাদন খরচ কমবে কীভাবে?

বিদ্যুতের দাম বাড়ানোয় খরচ বাড়বে সব শ্রেণীর গ্রাহকের। এবার ইউনিট প্রতি গড়ে ৭০ পয়সা বৃদ্ধিতে সর্বনিম্ন ২৮ পয়সা থেকে সর্বোচ্চ ১ টাকা ৩৫ পয়সা পর্যন্ত দাম বেড়েছে।

বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীদের বিল বেশি হবে। আর কেবল ফ্যান আর বিদ্যুৎ বাতি জ্বালিয়ে ৫০ ইউনিট পর্যন্ত খরচ করা গ্রাহকদের বিদ্যুৎ বিলে যোগ হবে অতিরিক্ত ১৪ টাকার মতো।

ছবির ক্যাপশান, সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন

তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন ১০ টাকা বৃদ্ধিও দরিদ্র গ্রাহকদের জন্য বাড়তি বোঝা হবে। ভবিষ্যতে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ কমানোর জন্য কার্যকর পদক্ষেপও সরকারকে নিতে হবে বলে অর্থনীতিবিদ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

সিপিডির নির্বাহী পরিচালক এবং অর্থনীতিবিদ ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ কমাতে দুটি বিষয়ের দিকে গুরুত্ব দিতে হবে।

“একটা হচ্ছে এই যে সিস্টেম লস কমানো। এটা যদিও আমরা অনেকটা কমিয়ে এনেছি এখন ৭/৮ শতাংশে এসেছে যেটা আগে ৩০-৪০ শতাংশ ছিল। এটা আরো কমানোর সুযোগ আছে”

“দ্বিতীয় আরেকটা হচ্ছে এই যে ক্যাপাসিটি পেমেন্ট যে তারা উৎপাদন করুক বা না করুক তাদেরকে (বিদ্যুৎ কেন্দ্র) কিন্তু পেমেন্ট করা হবে। এখন এই চুক্তিগুলো বাতিলের সময় এসেছে তাহলে কিন্তু আমাদের অনেক সাশ্রয় হবে,” বলছেন ফাহমিদা খাতুন।

ছবির উৎস,GETTY IMAGES ছবির ক্যাপশান, পায়রা কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র

অধ্যাপক ম তামিম মনে করেন, বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনতে হলে আমাদের দেশীয় জ্বালানি সম্পদ উত্তোলন এবং অনুসন্ধানে তৎপরতা বাড়াতে হবে।

“আমাদের দেশীয় গ্যাসের সরবরাহ কমছে এবং এলএনজির ওপর নির্ভরশীলতা আরো বাড়ছে এবং সামনে আরো বাড়বে। সুতরাং এটাকে কমিয়ে আনতে হলে আমি মনে করি যে আমাদে দেশীয় জ্বালানি সরবরাহ বৃদ্ধি করতে হবে।”

বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ কমানো এখন সরকারেরও মাথাব্যথার কারণ। কিন্তু আগামী দিনে ঠিক কী পরিকল্পনায় উৎপাদন খরচ কমানোর চিন্তা ভাবনা চলছে এ প্রশ্নে বিদ্যুৎ বিভাগের প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, উৎপাদন খরচ কমানোর পরিকল্পনা জ্বালানি বহুমুখীকরণ এবং নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বাড়ানোর পরিকল্পনা আছে।

ছবির ক্যাপশান, পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন

“আমাদের খরচ কমে আসবে আমরা যদি ফার্নেস অয়েল থেকে বেরিয়ে আসতে পারি। সবচেয়ে বড় খরচ এখন সেটা। এটা বেরিয়ে আসার জন্য আমাদের ধরুন এ বছর শেষ নাগাদ অথবা আগামী বছরের প্রথম দিকে নিউক্লিয়ারের প্রথম ইউনিট আসবে”

“আমাদের সোলার এখন ৬শ মেগাওয়াট আছে। গ্রিডে আগামী এক বছরে এটা আরো এক হাজার মেগাওয়াট যোগ হবে। যেটা দিনের বেলায় আপনার অন্তত ব্যয়বহুল জ্বালানি ব্যবহার করতে হবে। এছাড়া আমরা এফিসিয়েন্সি বৃদ্ধি করছি।”

বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি থেকে বেরিয়ে আসতে সরকার ধাপে ধাপে বিদ্যুতের দাম আরো বাড়াতে চায়।

এখানেও বড় সমালোচনা হচ্ছে, গণশুনানির মাধ্যমে স্বচ্ছতাও জবাবদিহির পথ বাদ দিয়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে সরকারের নির্বাহী আদেশে,এবং অনেকটা ইচ্ছে মতো।

মতামত নাই

একটা কিছু লিখে জান

আপনার মতামত টি লিখুন!
এখানে আপনার নাম লিখুন

error: Content is protected !!

Discover more from গ্রাম বাংলা

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Exit mobile version