সোমালি জলদস্যুদের কাছে জিম্মি এমভি আব্দুল্লাহর নাবিকদেরকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে রাখা হয়েছে। অস্ত্রের মুখে দস্যুদের কথা মেনে চলতে বাধ্য করা হচ্ছে। এই অবস্থায় জিম্মিদের অনেকেই মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন।
বৃহস্পতিবার বিকেলে পরিবারের কাছে পাঠানো এক অডিও বার্তায় এমনটাই জানিয়েছেন অপহরণের শিকার জাহাজের চিফ অফিসার আতিকুল্লাহ খান।
“সামনে দিয়ে ওরা অস্ত্র নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আশপাশে নেভি জাহাজ দেখলেই মাথায় অস্ত্র ঠেকাচ্ছে। মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে ওরা আমাদের জিম্মি করে রাখছে”, বলেন মি. খান।
তিনি আরও বলেন, “শারীরিকভাবে সুস্থ থাকলেও আমরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছি….আমাদের জন্য দোয়া করো।”
জাহাজটিতে অন্তত ২০ জন সশস্ত্র সোমালি জলদস্যু রয়েছে বলে জানিয়েছে ব্রিটিশ মেরিটাইম সিকিউরিটি কোম্পানি।
অপহরণের পরের দিন, অর্থাৎ বুধবার থেকে অপহৃত এমভি আব্দুল্লাহকে অনুসরণ করছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নৌ-বাহিনীর সদস্যরা।
জিম্মিদের উদ্ধারে তারা অন্তত দু’বার জাহাজের কাছে আসার চেষ্টা করেছে বলে জানিয়েছেন মি. খান।
“তারা আমাদের উদ্ধারের চেষ্টা করেছে। কিন্তু দস্যুরা অস্ত্রের মুখে আমাদের জিম্মি করে রেখে তাদেরকে ফিরে যেতে বাধ্য করেছে”, অডিওবার্তায় বলেন জিম্মি নাবিক আতিকুল্লাহ খান।
এ অবস্থার মধ্যেই বৃহস্পতিবার দুপুরে সোমালিয়া উপকূলে নোঙর ফেলেছে অপহৃত বাংলাদেশি কোম্পানির মালিকানাধীন জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহ।
নোঙর পড়েছে সোমালিয়ায়
অপহরণের দুই দিন পর সোমালিয়া উপকূলে নোঙর ফেলেছে এমভি আব্দুল্লাহ।
বৃহস্পতিবার বেলা একটার দিকে জাহাজটি সোমালিয়া উপকূলে পৌঁছায় বলে বিবিসি বাংলাকে নিশ্চিত করেছেন এটির মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান কেএসআরএম-এর গণমাধ্যম উপদেষ্টা মিজানুল ইসলাম।
“দুপুর একটার দিকে আমরা জানতে পেরেছি যে, জাহাজটি সোমালিয়া উপকূলে নোঙর করেছে। বিষয়টি আমরা নিশ্চিত হয়েছি,” বিবিসি বাংলাকে বলেন মি. ইসলাম।
জাহাজটি সোমালিয়ার গারাকাদ উপকূলে নোঙর করা হয়েছে।
লন্ডন ও কুয়ালালামপুর-ভিত্তিক জলদস্যুতা পর্যবেক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান ‘ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম ব্যুরো’র (আইএমবি) বরাত দিয়ে বিবিসি বাংলাকে এই তথ্য জানিয়েছে বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন।
সোমালি জলদস্যুদের পক্ষ থেকে এখনও পর্যন্ত কোনও যোগাযোগ করা হয়নি বলে জাহাজের মালিকপক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
১৩ বছর আগে একই কোম্পানির আরও একটি জাহাজ অপহরণ করেছিল সোমালি জলদস্যুরা। এমভি জাহান মণি নামের ওই জাহাজে ২৫ জন নাবিক এবং তাদের একজনের স্ত্রী ছিলেন।
অনেক দেনদরবার ও দরকষাকষি শেষে মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ দিয়ে ১০০দিন পর তাদেরকে মুক্ত করে দেশে আনা হয়।
সেই অভিজ্ঞতা থেকে ধারণা করা হচ্ছে যে, জলদস্যুরা এবারও বড় অঙ্কের মুক্তিপণ দাবি করতে পারে।
সেজন্য প্রস্তুতিও গ্রহণ করছে জাহাজের মালিকপক্ষ।
“নাবিকরা-সহ জাহাজটি নিরাপদে উদ্ধার করে আনাই আমাদের লক্ষ্য”, বিবিসি বাংলাকে বলেছেন কেএসআরএম-এর গণমাধ্যম উপদেষ্টা মিজানুল ইসলাম।
“সে জন্য ইতোমধ্যেই আমরা তৃতীয় একটি পক্ষের সাথে যোগাযোগ শুরু করেছি যেন দস্যুরা যোগাযোগ করা মাত্রই আমরা দ্রুত ব্যবস্থা নিতে পারি”, বলেন মি. ইসলাম।
জিম্মিদের কী অবস্থা?
জিম্মি নাবিকরা সবাই সুস্থ আছেন বলে দাবি করেছে জাহাজের মালিকপক্ষ।
“জাহাজের সাথে আমরা ফের যোগাযোগ স্থাপন করতে পেরেছি। নাবিকরা সবাই এখন সুস্থ আছেন বলে আমাদের জানিয়েছেন,” বিবিসি বাংলাকে বলেন মি. ইসলাম।
এদিকে, নাবিকদের কেউ কেউ পরিবারের সাথেও যোগাযোগ করেছেন।
“একদিন পর আজকে (বৃহস্পতিবার) ভোরে সেহরির পরে আমার ছেলের কাছ থেকে হোয়াটসঅ্যাপে একটি মেসেজ পেয়েছি,” বিবিসি বাংলাকে বলেন জিম্মি নাবিক আতিকুল্লাহ খানের মা শাহানুর বেগম।
মি. খান এমভি আব্দুল্লাহ’র চিফ অফিসার। জাহাজে জিম্মিদের সবাই সুস্থ আছেন বলে পরিবারকে জানিয়েছেন তিনি।
মোজাম্বিক থেকে ৫০ হাজার টন কয়লা নিয়ে দুবাই যাওয়ার পথে গত মঙ্গলবার দুপুরে এমভি আব্দুল্লাহ জাহাজটি সোমালি জলদস্যুদের কবলে পড়ে।
যুক্তরাজ্যের মেরিটাইম ট্রেড অপারেশনের তথ্য অনুযায়ী, জিম্মি করার সময় জাহাজটির অবস্থান ছিল সোমালিয়ার রাজধানী মোগাদিসু থেকে ৬০০ নটিক্যাল মাইল পূর্বে ভারত মহাসাগরে।
জাহাজটির ২৩জন নাবিকের সবাইকে জিম্মি করে রাখা হয়েছে।
মঙ্গলবার সন্ধ্যার দিকে খবরটি জানাজানি হয়। নাবিকদের কয়েকজন জাহাজটির মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ করে খবরটি জানান।
এছাড়া হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে পরিবারের সাথেও যোগাযোগ করেন জিম্মিদের অনেকে। কিন্তু মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর জলদস্যুরা সবার ফোন কেড়ে নেয়।
ফলে বুধবার সারাদিন নাবিকদের কারও সাথেই যোগাযোগ করতে পারেননি পরিবার ও জাহাজের মালিকপক্ষ।
প্রায় চল্লিশ ঘণ্টা পর বৃহস্পতিবার ভোরে ফের নাবিকদের সাথে যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে।
তাহলে কি নাবিকদের সবার ফোন ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে?
“সেটা মনে হয় না। অল্প সময়ের জন্য একটু যোগাযোগ করতে দিয়ে হয়তো আবার ফোন কেড়ে নিয়েছে। যার কারণে একবারই কোনোমতে একটা মেসেজ পাঠাতে পেরেছে”, বিবিসি বাংলাকে বলেন শাহানুর বেগম।
অন্য দিকে, স্বজনদের খোঁজ নিতে বৃহস্পতিবারও চট্টগ্রামে জাহাজের মালিকানা প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়ের সামনে ভিড় করছেন জিম্মি নাবিকদের পরিবারের সদস্যরা।
“মালিকপক্ষ বলছে যে, যত দ্রুত সম্ভব তারা জিম্মিদের উদ্ধারের ব্যবস্থা করছে”, বলেন মিজ শাহানুর।
‘কড়াকড়ি বাড়ছে’
এমভি আব্দুল্লাহ’র চিফ অফিসার আতিকুল্লাহ খানের বৃহস্পতিবার ভোরে তার পরিবারের কাছে হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে একটি বার্তা পাঠিয়েছেন।
সেখানে তিনি জানিয়েছেন যে, সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে তাদের চলাফেরার উপর কড়াকড়ি বাড়ানো হচ্ছে।
“আমার ছেলে জানিয়েছে যে, যতই সময় যাচ্ছে, ততই তাদের উপর কড়াকড়ি বাড়ছে”, বিবিসি বাংলাকে বলেন আতিকুল্লাহ খানের মা শাহানুর বেগম।
“আগে তারা সবাই একসাথে ছিল। এখন দশজন-দশজন করে আলাদা রাখা হয়েছে”, বলেন মিজ শাহানুর।
মূলত: বুধবার ইউরোপীয় ইউনিয়নের নৌ-বাহিনী জলদস্যুদের পিছু নেওয়ার পর থেকেই কড়াকড়ি আরও বাড়ানো হয়েছে।
“নৌবাহিনীর জাহাজ দেখার পর থেকেই দস্যুরা জিম্মিদের উপর কড়া নজর রাখা শুরু করেছে”, বিবিসি বাংলাকে বলেন মিজ শাহানুর।
তবে এ ব্যাপারে কোনো তথ্য জানেন না বলে বিবিসিকে জানিয়েছেন জাহাজটির মালিকানা প্রতিষ্ঠান কেএসআরএম-এর গণমাধ্যম উপদেষ্টা মিজানুল ইসলাম।
নজর রাখছে ইইউ-র জাহাজ
সোমালি জলদস্যুদের কবলে পড়া বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহকে অনুসরণ করছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নৌ বাহিনীর সদস্যরা।
বাহিনীটির বরাত দিয়ে বৃহস্পতিবার এই তথ্য জানিয়েছে মার্কিন বার্তা সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি)।
খবরে বলা হয়েছে যে, ‘অপারেশন আটালান্টা’র অংশ হিসেবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নৌবাহিনীর একটি জাহাজ অপহৃত এমভি আব্দুল্লাহকে অনুসরণ করছে।
মূলত: জলদস্যুদের উপদ্রব ঠেকানোর পাশাপাশি সাগরপথে চলাচলকারী জাহাজগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ২০০৮ সালে ভারত মহাসাগরের উত্তর-পশ্চিম অংশে ‘অপারেশন আটালান্টা’ নামে অভিযান শুরু করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নৌ সেনারা।
সোমালি জলদস্যুরা বাংলাদেশি একটি মালবাহী জাহাজ অপহরণ করেছে জানতে পেরে তারা এখন এমভি আব্দুল্লাহকে অনুসরণ করছে।
পরিবারের কাছে পাঠানো বার্তায় জিম্মি নাবিক আতিকুল্লাহ খান ‘নৌবাহিনীর’ যে জাহাজের কথা উল্লেখ করেছেন, ধারণা করা হচ্ছে সেটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের নৌবাহিনীরই জাহাজ।
উদ্ধার তৎপরতা কতদূর?
সোমালি জলদস্যুদের কবল থেকে জাহাজ ও জিম্মি নাবিকদের উদ্ধারে তৎপরতা শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছে জাহাজের মালিকপক্ষ।
“যদিও দস্যুদের পক্ষ থেকে এখনও আমাদের সাথে কোনও ধরনের যোগাযোগ করা হয়নি। তারপরও আমরা কাজ এগিয়ে রাখছি”, বিবিসি বাংলাকে বলেছেন জাহাজটির মালিকানা প্রতিষ্ঠান কেএসআরএম-এর গণমাধ্যম উপদেষ্টা মিজানুল ইসলাম।
“আমরা একটি এজেন্সির সাথে কথা বলে রেখেছি যেন দস্যুরা যোগাযোগ করা মাত্রই আমরা দ্রুত জিম্মিদের নিরাপদে উদ্ধার করতে পারি”, বিবিসি বাংলাকে বলেন মি. ইসলাম।
যুক্তরাজ্যের একটি প্রতিষ্ঠানে জাহাজটির বিমা করা ছিল। ফলে জাহাজ উদ্ধারে তারাও সক্রিয় ভূমিকা পালন করবে বলে জানা গেছে।
সে কারণে অপহরণের পর সেই বিমা কোম্পানির সঙ্গেও যোগাযোগ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে কেএসআরএম।
২০১০ সালে প্রতিষ্ঠানটির আরওএকটি জাহাজ সোমালি জলদস্যুদের কবলে পড়েছিল। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই মালিকপক্ষ বলছে, নাবিকদের উদ্ধারে কিছুটা সময় লাগবে।
“এক্ষেত্রে একটু সময় লাগে। অনেক সময় কয়েক মাসও লেগে যায়”, বলছিলেন মি. ইসলাম।
২০১০ সালে এমভি জাহান মণি জাহাজ ও নাবিকদের উদ্ধারে তিন মাসেরও বেশি সময় লেগেছিল। অনেক সময় জলদস্যুদের পক্ষ থেকেও দেরিতে যোগাযোগ করা হয়।
“তারা মূলত: মালিকপক্ষের ওপর চাপ সৃষ্টি করে দাবি আদায় করেই এটি করে থাকে”, বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন মিজানুল ইসলাম।
“তারপরও আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি যেন এবার দ্রুত সময়ের মধ্যে আমরা জিম্মিদের উদ্ধার করতে পারি”, বলেন তিনি।
এছাড়া সরকারিভাবেও নাবিকরা-সহ জাহাজটি উদ্ধারে চেষ্টা শুরু হয়েছে বলে বুধবার সাংবাদিকদের জানিয়েছেন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী।
বৃহস্পতিবার দুপুরে এটি নিয়ে একটি আন্ত:মন্ত্রণালয় বৈঠকও হয়েছে।
সেখানে সব পক্ষকে সঙ্গে নিয়ে কীভাবে সুষ্ঠুভাবে উদ্ধারকাজ সম্পাদন করা যায় এবং জিম্মিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়, সেটি নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে।
যদিও জিম্মিদের উদ্ধারের ব্যাপারে সরকারের তেমন কিছু করার নেই বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
“জলদস্যুরা সোমালিয়ার সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ফলে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে চেষ্টা চালিয়েও জিম্মিদের মুক্ত করা সম্ভব নয়”, বিবিসি বাংলাকে বলেন বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী সদস্য আবু সাঈদ।
“কাজেই দাবি পূরণ করেই তাদের মুক্ত করতে হবে”, জানান মি. সাঈদ।