ভারত মহাসাগরে পূর্ব আফ্রিকা উপকূলের সমুদ্রপথটি বরাবরই ঝুঁকিপূর্ণ। তাই, ওই উপকূল থেকে যথেষ্ঠ দূরত্ব বজায় রেখেই চলাচল করে সেই রুটের জাহাজগুলো।
আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিক থেকে মধ্যপ্রাচ্যের আবুধাবি আসার পথে ছিনতাই হওয়া বাংলাদেশি মালিকানাধীন জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ-র রুটও ছিল তীর থেকে প্রায় সাড়ে চারশো নটিক্যাল মাইল দূরে।
সাধারণত এত দূরত্বে সোমালিয়ান জলদস্যুদের আক্রমণ ‘সচরাচর দেখা যায় না’ বলেই জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
তা ছাড়া, সেই সময় কাছাকাছি দূরত্বে আরও জাহাজ থাকা সত্ত্বেও এই জাহাজটিকেই কেন টার্গেট করা হল?
আসলে যতই সময় যাচ্ছে, এই দস্যুতার ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য মিলছে। পাওয়া যাচ্ছে নানামাত্রিক বিশ্লেষণ।
তারা কেন এই জাহাজটিকেই বেছে নিল এমন প্রশ্নে বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী বিবিসি বাংলাকে বলেন, “ওদের টার্গেট সিলেকশন দুর্বল জাহাজের ওপর। যে জাহাজটা দুর্বল সেটাকেই ওরা ধরে।”
ওই জাহাজটির গতি কম ছিল, পানি থেকে ডেকের দূরত্ব কম, এসব ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েই দস্যুরা অগ্রসর হয়েছে বলে মন্তব্য করছেন তিনি।
আরও অনেক জাহাজ ওই রুটে চলছিল। সেগুলোকে ‘সেফগার্ড’ দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়, সশস্ত্র রক্ষীরা থাকে। যা এই জাহাজে ছিল না।
সাধারণত উপকূলের কাছাকাছি ঘটনাগুলো ঘটে উল্লেখ করে মি. চৌধুরী বলেন, “সে হিসেবে এটা রিস্ক জোনের বাইরেই ছিল।”
যেখান থেকে ডাকাতি করে নিরাপদে ফিরে যাওয়া যায়, সাধারণত সেগুলোকেই লক্ষ্যবস্তু হিসেবে বেছে নেওয়া হয়।
“এতো দূরে এমনটা হওয়া আনফরচুনেট”, বলছিলেন একটি বাণিজ্যিক জাহাজের চিফ ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ ওবায়দুল গণি।
মি. গণি বর্তমানে সৌদি আরব অভিমুখী একটি জাহাজে রয়েছেন। গভীর সমুদ্র থেকেই বিবিসি বাংলার সাথে কথা বলেন তিনি।
জাহাজটির নিরাপত্তা দুর্বলতা কীভাবে জানল জলদস্যুরা?
মার্চেন্ট মেরিনার এসোসিয়েশনের সভাপতি জানাচ্ছেন, দেড় মাসে আগে একটি ইরানি মাছধরা নৌযান জব্দ করেছিল জলদস্যুদের ওই দলটি।
এরপর থেকে তারা সেটাকে একটা ‘কমান্ড সেন্টার’ হিসেবে ব্যবহার করে আসছে।
জানুয়ারিতে এমন আরেকটি ইরানি যানের জিম্মি ক্রুদের উদ্ধার করেছিল ভারতীয় নৌবাহিনী।
সমুদ্রে চলাচলকারী সব নৌযানেই অটোমেটিক ইনফরমেশন সার্ভিস (এআইএস) নামে একটি প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়।
এতে একটি ছোট ডিভাইসের মাধ্যমে ৫০ নটিক্যাল মাইল দূরত্বের মধ্যে থাকা সব নৌযানের নাম, গন্তব্য, গতি ইত্যাদি তথ্য জানা যায়।
জলদস্যুরা এই ইরানি ফিশিং বোটে থাকা এই প্রযুক্তির সহায়তা নিয়েই এম ভি আবদুল্লাহ’র গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয়েছে বলে ধারণা ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরীর।
আর ওবায়দুল গণি মনে করেন, মাছ ধরা নৌযান ভেবেই হয়তো কাছাকাছি আসার পরও সন্দেহ জাগেনি আবদুল্লাহর নাবিকদের মনে।
তবে, সোমালিয়া উপকূল থেকে বেশি দূরত্বে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা আগেও ঘটেছে। ২০১০ সালে তেমনই এক ঘটনার শিকার হয়েছিল একই কোম্পানির জাহাজ এমভি জাহান মনি।
জাহান মনিকে দস্যুরা জব্দ করেছিল নিজেদের সৈকত থেকে ১৪ শ’ নটিক্যাল মাইল দূর থেকে। সাগরের এক নটিক্যাল মাইল স্থলপথে ১.৮৫ কিলোমিটারের সমতুল্য।
নিরাপত্তায় করণীয়, কতটা মানা হয়েছে
লোহিত সাগর, গালফ অফ এডেন, ভারত মহাসাগর ও আরব সাগরে দস্যুতা প্রতিরোধ এবং সামুদ্রিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ করে যুক্তরাজ্য ভিত্তিক সংগঠন ইউনাইটেড কিংডম মেরিটাইম ট্রেড অপারেশনস্ বা ইউকেএমটিও।
জাহাজ সুরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে তাদের বেশ কিছু নির্দেশনা রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে দস্যুতা প্রতিরোধে উল্লেখযোগ্য হল :
কাঁটা তার বা রেজর ওয়্যার
ঠিকঠাকভাবে স্থাপন করতে পারলে এটাই এসব ক্ষেত্রে সবচেয়ে কার্যকর সুরক্ষা পদ্ধতি।
৭৩০ বা ৯৮০ মিলিমিটার ব্যাস রেখে চক্রাকারে ভালোমানের তার ব্যবহার করলে হাতে ব্যবহৃত কোনও সরঞ্জাম দিয়ে সেগুলো কাটা কারো পক্ষে কঠিন হবে।
ডাবল রোল ব্যবহার করতে পারলে ভালো। এটি সম্ভব না হলে, জাহাজের কাঠামোর বাইরের দিকে একটি রাখার কথা বলা হয়েছে।
কিন্তু, এমভি আবদুল্লাহ’র কোনো রেজর ওয়্যার ছিলো না।
মোজাম্বিক অপেক্ষাকৃত দরিদ্র দেশ হওয়ায় সেখানে রেজর ওয়্যার পাওয়া যায় কিনা তা নিয়েও অবশ্য সন্দিহান ক্যাপ্টেন চৌধুরী।
সিটাডেল
সিটাডেলকে দুর্গ বললেও ভুল বলা হবে না। জাহাজ নির্মাণের সময়ই এমন একটা কক্ষ রাখা হয় যেখানে জলদস্যু বা অন্য কোনও সামরিক আক্রমণের মুখে ক্রুরা অবস্থান নিতে পারে।
ভেতর থেকে দরজা আটকে দিলে সেটি একরকম অভেদ্য হয়ে যায়।
মি. গণি জানান, সেখানে খাবার মজুদ থাকে, কমিউনিকেশনের জন্য স্যাটেলাইট ফোন থাকে।
“সিটাডেল এমন জিনিস যে মর্টার শেল দিয়েও কেউ এর দরজা ভাঙতে পারবে না,” বিবিসিকে বলছিলেন ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী।
তিনি বলেন, “সিটাডেলে যাওয়ার আগে টোটাল পাওয়ার অফ করে দিয়ে জাহাজকে স্টপ করতে হয়।”
এমভি আবদুল্লাহ’র সদস্যদের বেশির ভাগই সেখানে অবস্থান নিয়েছিলেন। শুধু জাহাজের ব্রিজে মাস্টার এবং সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। আর নিচে ছিলেন একজন সেকেন্ড অফিসার।
তাদের জিম্মি করে ফেলার পর বাকিরাও বের হয়ে আসতে বাধ্য হয়েছেন বলে জানাচ্ছেন এই সাবেক ক্যাপ্টেন।
চালনা-কৌশল
মাস্টার এবং অফিসারদের জাহাজের পরিচালনার ‘ম্যানুভার’ শিখে রাখা উচিত। ম্যানুভার হলো জাহাজকে দক্ষতার সাথে চক্রাকারে বা এলোপাতাড়ি চালানো।
এতে চারপাশে প্রবল ঢেউ সৃষ্টি হয়। দস্যুদের নৌযান আর ভিড়তে পারে না।
আক্রমণের মুখে সর্বোচ্চ গতিতে জাহাজ চালানোর পরামর্শও দেয়া হয়েছে। সম্ভাব্য সর্বোচ্চ গতির সঙ্গে ম্যানুভার বজায় রাখার চেষ্টা করা উচিত মাস্টারের।
মি. আনাম চৌধুরীর ধারণা, ওই জাহাজের মাস্টার হয়তো শেষ পর্যন্ত ম্যানুভার করার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু ডাকাতরা যখন বোর্ড (আরোহণ) করে ফেলেছে, তখন আর পেরে ওঠেননি।
অস্ত্রধারী নিরাপত্তারক্ষী
ঝুঁকি বিবেচনায় প্রাইভেট মেরিটাইম সিকিউরিটি সংক্রান্ত নীতিমালা মেনে অস্ত্রধারী নিরাপত্তা রক্ষী নিয়োগ দেয়ার পরামর্শ দেয় ইউকেএমটিও।
কিন্তু, জিম্মি জাহাজটিতে কোন আর্মড গার্ডস্ বা অস্ত্রধারী নিরাপত্তারক্ষী ছিলেন না।
ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী বলেন, “ভিডিও দেখে বোঝা যায় (দস্যুরা) সব মার্সেনারি, রিটায়ার্ড মিলিটারি পার্সোনাল। সবাই ট্রেইনড্, সিভিলিয়ান বা ছিঁচকে চোর নয়।”
এমন বাস্তবতায় নিরস্ত্র ক্রু-রা আরও অসহায় হয়ে পড়েছিলেন।
ওয়াটার স্প্রে
ওয়াটার স্প্রে বা জল কামান ব্যবহার করেও অবৈধভাবে জাহাজে চড়ার যে কোনও প্রচেষ্টাকে ঠেকিয়ে দেওয়া যায়।
পানির তীব্র বেগে কোনও ছোট নৌযানের কাছাকাছি থাকাই কঠিন হয়ে পড়ে। আরোহণ তো প্রায় অসম্ভব।
কিন্তু, পেশাগত সূত্রে পাওয়া তথ্য থেকে মি. চৌধুরী ও মি. গণি উভয়েই নিশ্চিত করেছেন এমভি আবদুল্লাহতে তাও ছিলো না।
নজরদারি ও বাড়তি সতর্কতা
একটু উঁচু জায়গা থেকে সার্বিক তদারকি করা জরুরি।
জাহাজের ব্রিজের (চালানোর স্থান) জন্য পর্যাপ্ত অ্যান্টি-গ্লেয়ার দূরবীন, থার্মাল ইমেজ অপটিক্স এবং নাইট ভিশন থাকার কথাও বলেছে ইউকেএমটিও।
জাহাজের কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো ভালোভাবে নির্মিত ডামি রাখলে ক্রুর সংখ্যা বেশি মনে হয়।
ব্রিজের দুপাশে অ্যান্টি-পাইরেসি মিরর বা আয়না লাগনো উচিত। এতে দস্যুদের গতিবিধি বোঝা সহজ হয়।
জাহাজ সুরক্ষার সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতিই হলো এই নজরদারি।
যদিও জলদস্যুদের হাতে ফিশিং ভেসেলের নিয়ন্ত্রণ থাকায় এমভি আবদুল্লাহর ক্রুদের বিভ্রান্ত হতে হয়েছিলো বলে ওবায়দুল গণির মত।