হোম বিশ্ব ভারত, নেপাল ও বাংলাদেশের সমীকরণ

ভারত, নেপাল ও বাংলাদেশের সমীকরণ

0
ভারত নেপাল ও বাংলাদেশের

নেপাল থেকে সরাসরি বাংলাদেশ সীমান্ত পর্যন্ত একটি করিডোরের জন্য জমি যদি ভারত নেপালকে হস্তান্তর করে, তাহলে নেপালও ভারতকে ৩১০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা হস্তান্তর করতে পারে।

নেপাল-ভারত সীমান্ত বিবাদ মেটাতে এরকমই একটা বিকল্পের কথা সামনে এসেছে। এখন ভারতের ভূখণ্ড দিয়েই নেপাল আর বাংলাদেশের মধ্যে পণ্য চলাচল করে।

তবে নেপাল চাইছে ‘চিকেন নেক’ বলে পরিচিত ভারতের ওই এলাকা যদি নেপালকে হস্তান্তর করে দেওয়া হয়, তাহলে তারাও পশ্চিম নেপালের যেসব এলাকা নিয়ে তাদের সঙ্গে ভারতের বিরোধ আছে, সেই অঞ্চলও ভারতকে দিয়ে দিতে পারে।

নেপালের প্রধানমন্ত্রী প্রচণ্ডার সাম্প্রতিক ভারত সফরের পরে দুই দেশের সীমান্ত বিরোধ মেটাতে এরকমই একটা বিকল্পের কথা ভাবছেন নেপালি বিশেষজ্ঞরা।

তবে ভারতীয় বিশ্লেষকরা মনে করছেন পশ্চিম নেপালের কালাপানি এবং লিপুলেখ নদী অঞ্চল এবং পশ্চিমবঙ্গের চিকেন নেক করিডোর দুটিই ভারতের কাছে সামরিক ভাবে অতি গুরুত্বপূর্ণ, তাই ভারত সম্ভবত এরকম একটা বিকল্পে রাজি হবে না।

নেপালের প্রধানমন্ত্রী প্রচন্ডা (বাঁয়ে) ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী (ডানে)
নেপালের প্রধানমন্ত্রী প্রচন্ডা (বাঁয়ে) ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী (ডানে)

ছবির উৎস,EPA

প্রচণ্ডার ভারত সফরের পরেই বিকল্পের খোঁজ

সম্প্রতি ভারত সফরে আসা নেপালের প্রধানমন্ত্রী পুষ্প কমল দহল প্রচন্ডা বলেছেন, তার দেশ শুরু থেকেই বাংলাদেশে সরাসরি একটি রুট চায়।

নেপালে ফিরে আসার পর, প্রচন্ডা বলেছিলেন যে তিনি নেপালি সীমান্ত বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বেশ কয়েকটি বিকল্প নিয়ে আলোচনা করেছেন কিন্তু তার পক্ষ থেকে কোনও সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দেননি।

নেপালের সীমান্ত বিশেষজ্ঞ বুধিনারায়ণ শ্রেষ্ঠা বলেন, কালাপানি এলাকা নিয়ে ভারত ও নেপালের মধ্যে বিরোধ গত ছয় দশক ধরে চলে আসছে।

তার কথায়, “যে মানচিত্র নিয়ে ভারত ও নেপালের মধ্যে বিরোধ, তার সমাধানের একটা উপায় হতে পারে আন্তর্জাতিক রীতি মেনে এলাকা বিনিময় করা।

লিপুলেখকে সীমান্ত নদী হিসাবে বিবেচনা করে উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলের ৩১০ বর্গকিলোমিটার জমি ভারতের জন্য ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে।

আবার ভারতের কাছ থেকে পূর্ব দিকের ৩১০ বর্গকিলোমিটার জমি নিয়ে একটি করিডোর করা যেতে পারে, যাতে পূর্ব নেপালের কাকরভিট্টা সীমান্ত থেকে সরাসরি বাংলাদেশের বাংলাবান্ধা সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছনো যায়।”

নেপালের তিনদিকের সীমান্তই উন্মুক্ত

সীমান্ত বিরোধে ভারতীয় বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিভঙ্গি

ভারতীয় বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে এটি একটি গুরুতর সমস্যা এবং ভারত বিশ্বাস করে যে তারা এমন কোনও পদক্ষেপ নেবে না যাতে চীনের সঙ্গে ভারতের বর্তমান উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে তাদের নিজেদের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হয়।

অবসরপ্রাপ্ত ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল এস বি আস্থানা বলেছেন, “এই সমস্যাটি সমাধানের জন্য সঠিক সময় নয় এটা। আমরা অন্যান্য অনেক সমস্যার সঙ্গে লড়াই করছি।”

ভারত ও চীনা সেনারা বেশ কিছুদিন ধরে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর মুখোমুখি অবস্থান করছে।

নেপালের প্রধানমন্ত্রী প্রচন্ডা মনে করেন, ভূমি বিনিময়ের মাধ্যমে ভারতের সঙ্গে নেপালের সীমান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি করা সম্ভব।

তবে ভারতের সামরিক বিশ্লেষকরা বলছেন যে তাদের মনে হয় না যে এখনই কোনও বিকল্প নিয়ে আদৌ আলোচনা করা হচ্ছে।

তা সত্ত্বেও, তাদের মতে, প্রচণ্ডা ও নরেন্দ্র মোদীর মধ্যে বৈঠকে দেওয়া প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে যদি দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত বিরোধ মেটানোর কোনও ব্যবস্থাপনা কাজ শুরু করে, তা হবে বিরাট সাফল্য।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী প্রচণ্ডার সঙ্গে দেখা করার পর বলেছিলেন যে এই বৈঠক ভারত ও নেপালের মধ্যে সম্পর্ককে হিমালয়ের উচ্চতায় নিয়ে যাবে এবং দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত বিরোধ তাদের জনগণের অনুভূতির ভিত্তিতে সমাধান করা হবে।

কালাপানি অঞ্চল নিয়ে ভারত আর নেপালের মধ্যে সীমান্ত বিরোধ চলছে বহু বছর ধরে

ছবির উৎস,GETTY IMAGES

ভারত, নেপাল ও কালাপানি বিরোধ

নেপালি সাংবাদিকদের সাথে কথা বলার সময়, প্রচন্ডা বলেছিলেন যে ভারত ও নেপালের মধ্যে সীমান্ত বিরোধ সমাধানের জন্য অন্যান্য বিকল্প পথ খোঁজা যেতে পারে।

কালাপানি এলাকার মালিকানা নিয়ে নেপাল ও ভারতের মধ্যে দীর্ঘদিনের বিরোধ রয়েছে।

নেপাল ও ভারতের মধ্যে ১৮১৬ সালে সুগৌলি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এর আওতায় মহাকালী নদীকে ভারত ও নেপালের সীমান্ত হিসেবে বিবেচনা করা হতো। দীর্ঘদিন ধরে এর উৎস নিয়ে দুই দেশের মধ্যে বিরোধ চলে আসছে।

নেপালের কর্মকর্তারা বলছেন, ভারতের স্বাধীনতার পর বেশ কিছু বছর কালাপানি এলাকা নেপালের অধীনে ছিল। স্থানীয় জনগণ নেপাল সরকারকে রাজস্ব দিতেন, তাদের কাছে এর প্রমাণও রয়েছে।

ভারতীয় বাহিনীকে সেখানে অস্থায়ীভাবে থাকার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল।

২০১৯ সালে ভারত শাসিত কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহার করার সময়ে যে নতুন মানচিত্র প্রকাশ করে ভারত, সেখানে কালাপানিকে ভারতীয় ভূখণ্ডে দেখানো হয়েছিল।

এর প্রতিক্রিয়ায় নেপাল তার রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক মানচিত্রে কালাপানি, লিপুলেখ এবং লিম্পিয়াধুরাকে তাদের নিজেদের অঞ্চল হিসাবে দেখিয়েছিল।

ভারতের দিকে ফুলবাড়ী, সীমান্তের ওপারে বাংলাবান্ধা

ছবির উৎস,GETTY IMAGES

ভারতের জন্য সামরিক কৌশলগত এলাকা

ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল এসবি আস্থানার মতে, ভারতের কাছে এই অঞ্চলটির কৌশলগত গুরুত্ব অপরিসীম। এটি চীনের সীমান্তের কাছে অবস্থিত লিপুলেখ গিরিপথ আর কৈলাস মানস সরোবরের সংযোগকারী রাস্তার সঙ্গে যোগাযোগের পথ।

তিনি বলেন, “ভারত ও নেপাল উভয়েরই নিজস্ব যুক্তি রয়েছে। আমি বিশ্বাস করি নেপালের উদ্বেগগুলো নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ এবং সেগুলি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা উচিত। ভারতকেও অনেক ভাবতে হবে। কারণ প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখার ওপারেই চীনা সেনারা অবস্থান করছে।“

ভারতীয় সেনাবাহিনীর আরেক অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল অশোক মেহতা, যিনি নেপাল-ভারত সম্পর্কের উপর নজর রাখেন, তিনি মনে করেন যে উভয় পক্ষই এই সীমান্ত বিরোধ সমাধান করতে আলোচনা চালানোর যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তা খুবই ইতিবাচক।

কিন্তু সম্ভাব্য দর কষাকষিটা সহজ হবে না। এ নিয়ে যথেষ্ট জটিলতা রয়েছে। তিনি বলেন, “নেপাল একতরফা ভাবে বিতর্কিত এলাকাগুলিকে মানচিত্রে অন্তর্ভুক্ত করে সংবিধান পরিবর্তন করেছে। কিন্তু এই জমি ভারতের দখলে রয়েছে।

“এখন এটি একটি ‘নিরপেক্ষ’ এলাকার বদলে অনেকটা যেন কাশ্মীরের মতো পরিস্থিতি তৈরি করে দিয়েছে। তাই কোথা থেকে আলোচনাটা শুরু হবে, সেটা বড় প্রশ্ন,” বলছিলেন জেনারেল মেহতা।

সীমান্ত বিবাদ নিয়ে ভারত বিরোধী বিক্ষোভ কাঠমাণ্ডুতে – ফাইল চিত্র

ছবির উৎস,EPA

চিকেন নেক করিডোরের ভূমিকা

২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যখন প্রথমবারের মতো কাঠমাণ্ডু সফর করেছিলেন, তখনই বলা হয়েছিল যে কালাপানি এবং লাদাখের আলছি এলাকা নিয়ে যেসব বিরোধ আছে, তা নিয়ে বিদেশ সচিব পর্যায়ের আলোচনায় সমাধান বার করা হবে।

কিন্তু এই উদ্দেশ্যে একটি বৈঠকও হয়নি।

নেপালের কয়েকজন কর্মকর্তা বলছেন, মানচিত্র নিয়ে বিরোধ অব্যাহত থাকলেও সীমান্ত ব্যবস্থাপনার প্রযুক্তিগত কাজও খুবই ধীরগতিতে চলছে।

যৌথ সংবাদ সম্মেলনে সীমান্ত বিরোধ নিয়ে প্রচণ্ডা ও নরেন্দ্র মোদী দুজনেই কিছুটা আলোচনা করেন। কিন্তু ভারতের দেওয়া ২৪ দফা প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এর কোনও উল্লেখ ছিল না।

আবার জমি হস্তান্তর নিয়ে নেপালে যে বিতর্ক চলছে, তা নিয়েও ভারতের পক্ষ থেকে কোনও আনুষ্ঠানিক মতামত দেওয়া হয়নি।

মি. আস্থানা বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে নেপালের সংযোগকারী সড়কটি শিলিগুড়ি করিডোরের কাছাকাছি এবং এটি ভারতের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণে ভারত কখনই এ নিয়ে আপোষ করবে না।

এই করিডোরকে চিকেন নেকও বলা হয়। এই এলাকা মাত্র ১৭ কিলোমিটার চওড়া। এটি পশ্চিমবঙ্গকে উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলির সঙ্গে যুক্ত করেছে।

এটি নেপাল, বাংলাদেশ ও ভুটান – তিনটি দেশের সীমান্তেরই খুব কাছে। আবার উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে বাকি দেশের সংযোগ রক্ষা করে এই অংশটিই।

তাই একে উত্তর-পূর্বের জীবন-রেখাও বলা হয়।

এই এলাকার রেলওয়ে নেটওয়ার্ক ভারতীয় সেনাবাহিনীকে ভারত-চীন সীমান্তের কাছে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা পর্যন্ত পৌঁছতে সাহায্য করে।

জেনারেল আস্থানা বলেছেন, “কোন সন্দেহ নেই যে শিলিগুড়ি করিডোর ভারতের জন্য ব্যাপক গুরুত্বপূর্ণ। তাই এটা নিয়ে ভারত আপোষ করবে না।

ভারতের ফুলবাড়ী সীমান্তে ঢাকা থেকে সরাসরি কাঠমাণ্ডু বাস পরিষেবার পরীক্ষামূলক যাত্রা – ফাইল চিত্র

ছবির উৎস,GETTY IMAGES

ভারত, নেপাল ও বাংলাদেশের সমীকরণ

মি. আস্থানা বলেন, “আমরা শুধু ভারতীয় ভূখণ্ডে চীনা সেনাদের থামাইনি। আমরা ভুটানের ভূখণ্ডে পৌঁছিয়ে গিয়েছিলাম। বুঝতেই পারছেন ভারত এই এলাকার ভৌগোলিক অবস্থানকে কতটা গুরুত্বের সঙ্গে দেখে।“

তিনি বলেন, এই করিডোর নিয়ে যেকোনো ধরনের চুক্তি হলে তা হবে ভারতকে দুই ভাগে ভাগ করার মতো। কারণ উত্তর-পূর্বের সঙ্গে ভারতের যোগাযোগের এটাই একমাত্র পথ।

কাকড়ভিট্টা-ফুলবাড়ি-বাংলাদেশ ট্রানজিট রুট সম্পর্কে নেপাল ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ১৯৯৭ সালে।

এরপর বাংলাদেশ নেপালকে মংলা ও চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের অনুমতি দেয়।

জেনারেল মেহতা বলেছেন যে শিলিগুড়ি করিডোরের কৌশলগত গুরুত্ব সম্পর্কে ভারতের সবাই জানে।“

তিনি আরও বলছিলেন যে নেপালের প্রধানমন্ত্রী এই বার্তা দিয়েছেন যে তিনি সীমান্ত ইস্যুতে কোনও চাপের মুখে পড়েন নি। তিনি ইঙ্গিত দিচ্ছেন যে, তারা ভারতের সঙ্গে সীমান্ত বিরোধ নিয়ে আলোচনা শুরু করেছে।

“আমার মনে হয় যে পররাষ্ট্র সচিবদের মধ্যে আলোচনা শুরু হতে পারে। অন্তত মানুষ বুঝবে যে আলাপ আলোচনা শুরু হয়েছে। তবে আমার মনে হয় না যে আলোচনাটা খুব সহজ হবে,” মন্তব্য জেনারেল মেহতার।

নেপালের কাকরভিট্টা সীমান্ত, এখান থেকেই বাংলাদেশ সীমান্ত পর্যন্ত করিডোর করার বিকল্প ভাবছে নেপাল

ছবির উৎস,GETTY IMAGES

মতামত নাই

একটা কিছু লিখে জান

আপনার মতামত টি লিখুন!
এখানে আপনার নাম লিখুন

error: Content is protected !!

Discover more from গ্রাম বাংলা

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Exit mobile version